Wednesday, September 07, 2011

দিল্লিতে নাশতা, চট্টগ্রামে লাঞ্চ মান্দালয়ে রাতের খাবার


কয়েক বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আশা প্রকাশ করেছিলেন- দিল্লিতে নাশতা, লাহোরে লাঞ্চ আর কাবুলে রাতের খাবার খাবেন। ভারতের পশ্চিমের দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে মনমোহন এমন স্বপ্ন ব্যক্ত করেছিলেন। ভারত আশা করেছিল, শান্তি আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে একটা চমৎকার সম্পর্কে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু মুম্বাইয়ে হোটেল তাজে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা তার সে আশার গুড়ে বালি ফেলে দেয়। এখন ঢাকা সফরের আগে ভারতের কয়েকজন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী তার সে ইচ্ছার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য সি. রাজা মোহন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় দুটি কলাম লিখে এ বিষয়ে মনমোহন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন তিনি। বলেছেন, পশ্চিম সীমান্তে যা হয়নি পুবে তা হতে দোষ কি? মনমোহন দিল্লিতে নাশতা, চট্টগ্রামে লাঞ্চ আর মান্দালয় বা কুনমিংয়ে রাতের খাবারের কথা ভাবছেন না কেন? ভারতীয় বিশ্লেষকদের মধ্যে পূর্বদিকে সম্পর্কোন্নয়নের এই আইডিয়া আসার পেছনে বড় একটি কারণ চীন। বেশ কয়েক দশক ধরে প্রতিবেশীদের বেলায় চীন যে নীতি অনুসরণ করছে তা শুধু এশিয়াতে নয়, পুরো বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে প্রতিবেশীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চীন। তাদের সঙ্গে উন্নয়ন, অগ্রগতি ভাগ করে নিতে চেয়েছে। বিনিয়োগ, ব্যবসা, বাণিজ্য, যোগাযোগে তাদের সহায়তা করেছে। এর ফল হয়েছে দারুণ। দেখা গেছে, সীমান্তজুড়ে চীনের বন্ধুর শেষ নেই। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অগ্রগতি হয়েছে সত্য, কিন্তু প্রতিবেশীদের তাতে কোনো ভাগ নেই। ভারতের চারদিকে বিরোধিতাই মূল আবহসঙ্গীত হিসেবে বেজে চলেছে। বিশ্বে শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে গেলে এটা সুখকর কোনো অবস্থান হতে পারে না। তাই ক্ষীণ হলেও ভারতে এখন সমঝোতার কূটনীতি জায়গা করে নিয়েছে। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তো আছেই। নিজেদের স্বার্থেও ভারতের এখন এটি দরকার। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে এ মনোভাবের ছাপ পড়তে পারে বলে আশা করছিলেন কেউ কেউ। সি. রাজা মোহন মনে করেন, এ সফরটি 'গেম চেঞ্জার' বা 'খেলার বদল ঘটানো' উদ্যোগ। রাজা মোহন বলেছেন, মনমোহনের এই সফর শুধু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের জন্যই একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এবং চীন পর্যন্ত এ সফরের প্রভাব পড়তে পারে। তার মতে, ভারতের জন্য এটি একটি সুযোগ। বাংলাদেশও মনে করে ট্রানজিটকে বাংলাদেশ- ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিস্তৃত করা দরকার। ট্রানজিট থেকে ভারত যেমন তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে তেমনি বাংলাদেশেরও উপযুক্ত ট্রানজিট মাশুল পাওয়া উচিত। দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের বাইরে নেপাল-ভুটান পর্যন্ত ট্রানজিট সুবিধা বিস্তৃত হওয়া উচিত। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরেই উপমহাদেশের পূর্বাংশের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে চীন উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এতে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সঙ্গে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল এবং পূর্ব ভারতের আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ইউনান থেকে মিয়ানমার-বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত রেল সংযোগ স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। ব্রিটিশরাজ যা পারেনি তা এবার সম্ভব হচ্ছে। মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল ট্রানজিটের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। রাজা মোহন মনে করেন, এই সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উচিত শেখ হাসিনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে দক্ষিণ এশীয় রেল নেটওয়ার্কে ভারতের যুক্ত হওয়ার পথে শক্ত অবস্থান নেওয়া। রাজা মোহনের মত যে খুব গৃহীত হচ্ছে তা নয়। বরং এখনও রক্ষণশীল প্রতিবেশী নীতিই ভারতে প্রধান। মনমোহন সেই রক্ষণশীলতা কাটিয়ে চীনের মতো ভারতকেও আঞ্চলিক নেতার মর্যাদায় নিয়ে যেতে পারবেন কি-না, প্রতিবেশীদের ছাড় দিয়ে, সুযোগ দিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করতে পারবেন কি-না সেটি ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।