Thursday, July 26, 2007

An Interview with Nasir Uddin Yusuf


After 50th Staging of Binodini eminent Bangladeshi director Nasir Uddin Yusuf staged a new drama called Nimajjan written by Selim Al Deen. After the first show many called it as a new experience on the stge of Dhaka. I and Saymon Zakaria Talked with him about this drma and his thoughts about dramatics. Syeem Rana was present on the event. Snapshot of yusuf was taken by Hasan Bipul.
ঢাকার মঞ্চে বিনোদিনী নাটকের ৫০তম প্রদর্শনীর পর নাসির উদ্দিন ইউসুফ মঞ্চে নিয়ে এলেন নতুন নাটক নিমজ্জন। এটি ঢাকা থিয়েটারের ৩২তম প্রযোজনা। প্রথম মঞ্চায়নের পর নাটকটি দর্শকের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের মঞ্চে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বরাবরই নতুন ও বিস্ময়কর ধারার জন্ম দিয়েছেন। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এবার তিনি মঞ্চায়িত করলেন স্থান-কাল নিরপেক্ষ একটি নাটক। নাটকটি লিখেছেন সেলিম আল দীন।
বিশ্বের নানা অঞ্চলে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, সামরিক শাসন, অপঘাতের বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে লেখা হয়েছে নাটকটি। এতে আছে মানুষের অসহায়তা, প্রতিরোধ ও যুদ্ধের প্রতি ঘৃণার কাহিনীও। বহু বিস্তারি এ নাটকটিকে আশ্চর্য দক্ষতায় নাট্যরূপ দিয়েছেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মঞ্চায়নের পর দর্শকরা একে বিশ্ব মানের একটি পরিবেশনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ নাটক ও তার নাট্য চিন্তা নিয়ে কথা বলেছেন যায়যায়দিনের সঙ্গে। কথা বলেছেন সাইমন জাকারিয়া ও মাহবুব মোর্শেদ। উপস্থিত ছিলেন সাইম রানা। ছবি তুলেছেন হাসান বিপুল।

আপনার নাটকের জার্নিটা আমরা জানি, সংবাদ কার্টুন থেকে মুনতাসির, শকুন্তলা, কেরামতমঙ্গল, কীর্তনখোলা, হাতহদাই। একেকটা পদক্ষেপের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সর্বশেষ বিনোদিনী থেকে নিমজ্জন। এ দুটি নাটকের মধ্যেও বিস্তর পার্থক্য। একটা নাটক থেকে আপনার আরেকটা নাটক আলাদা হয় কিভাবে? চিন্তাগুলো কিভাবে আসে?

প্রথমত টেক্সট একটা জায়গা নির্ধারণ করে দেয়। টেক্সট একভাবে দাবি করে। নির্দেশককে টেক্সটই বলে দেয়, এটা আমি চাই। আর সময়টাও বলে। সময় একটা জায়গা তৈরি করে। কথার কথা হিসেবে বলছি, বিনোদিনী একটা সিম্পল, লিনিয়ার একটা কাজ। কিন্তু তার মধ্যেও অনেক বুনন আছে। সাধারণ একটা লিনিয়ার টেক্সটকে সুন্দর ঝকঝকে একটা প্রযোজনা করা এবং তাতে অভিনয় দক্ষতার প্রয়োগ ঘটানো।
অভিনয় দক্ষতাটা ছিল বিনোদিনীতে আমার মূল লক্ষ্য। দেখাতে চেয়েছিলাম পাওয়ার অফ অ্যাক্টিং কিভাবে একটা টেক্সটকে নাটক হিসেবে শৈল্পিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে নিমজ্জন বা অন্য যে কোনো জটিল নাটকে লক্ষ্য থাকে জটিল নাটকটিকে কতো সহজভাবে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা যায়। এগুলোতে দেখা যাবে প্রচুর কাজ আছে, প্রচুর অ্যাকশন বা মঞ্চ ক্রিয়া আছে এবং সেগুলোর সমন্বয় করতে হয়েছে। কোন প্রক্রিয়ায় কাজটা করি সেটা বলা মুশকিল। এমনকি সাইমনের বিনোদিনীর যে এ রকম প্রডাকশন হবে সেটা আমি বা সাইমন কেউই ভাবিনি। এখানেও তাই। প্রথমত একটা চেষ্টা ছিল। আমার একটা ভাবনা ছিল। একটা থেকে আরেকটার ফারাক ঘটে সময়, অভিজ্ঞতা, টেক্সটের একটা দাবি এগুলোর ফলে।

মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে আপনি কখনো প্রসেনিয়াম ব্যবহার করছেন। কখনো নাটককে মেঝেতে নামিয়ে আনছেন। নিমজ্জনের ক্ষেত্রে আমরা প্রসেনিয়ামের ব্যবহার দেখলাম।

আমার সব নাটকই বাইরে করার মতো। এ প্রযোজনাটি বাইরে অসম্ভব ভালো লাগবে। আমি বলে দিতে পারি, যদি গ্যালারিতে দর্শক বসে এবং ফোরে নাটকটি হয় তাহলে এটি আরেকটি মাত্রা পাবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ আমরা যখন রিহার্সাল করেছি সেটা ফোরে করেছি এবং আমরা সেটা গ্যালারি থেকে দেখেছি।

দর্শকের কথা কি আপনি মাথায় রাখেন?

না, দর্শকের কথা আমার মাথায় থাকে না। থাকলে মনে হয় না যে, আমি নিমজ্জন করতাম। আমি প্রথমত আমার শিল্পকর্মটাই করি। আমি নিজেকে নিজে এন্টারটেইন করি। আসলে মানুষের প্রথম কাজ হচ্ছে, বাচার জন্য নিজেকে নিজে এন্টারটেইন করা। কেউ যখন লেখেন, তিনি লিখতে লিখতেই কিন্তু এন্টারটেইন হন। আমি কোনো লঘু এন্টারটেইনমেন্টের কথা বলছি না। শৈল্পিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যে এন্টারটেইনমেন্ট থাকে আমি সেটার কথা বলছি। পরিশ্রমের মধ্যে এন্টারটেইনমেন্ট থাকে। কেউ যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হাটছে বা লিখছে সে প্রক্রিয়ার মধ্যেই তার এন্টারটেইনমেন্ট থাকে। এটা মানে তো শুধু দুটি নাচ-গান না বা ওয়েস্টার্ন মিউজিক নয়। যদি দর্শকের কথা বলি তবে দর্শক লঘু সঙ্গীতেও আনন্দ পায়, ইনডিয়ান কাসিক শুনেও আনন্দ পায়, নজরুল সঙ্গীতেও পায়, রবীন্দ্র সঙ্গীতেও পায়। প্রশ্নটা খুবই প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, আমার নির্দেশিত বিভিন্ন নাটক বিভিন্ন চরিত্র ধারণ করেছে।

থিয়েটারে খুব কম নির্দেশকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় তার একটা নাটক থেকে আরেকটা নাটক আলাদা হয়।

সেটা মনে হয় ডিজাইনের কারণে ঘটে। ওরা যে প্রডাকশন ডিজাইন করে সেখানে আমার মনে হয় সবারই ভাবার অবকাশ আছে। আমরা যখন একটা প্রডাকশন থেকে আরেকটা প্রডাকশনের দিকে যাবো তখন সেই মধ্যবর্তী সময়ে আগের শেখা কিছু জিনিস আনলার্ন করবো। নতুন কিছু জিনিস জানবো। নতুন কিছু ভাষা শিখবো। শিল্পের ভাষা আমাকে আয়ত্ত করতে হবে। সে প্রক্রিয়াটা আছে কি না আমি জানি না। কিন্তু আমার মধ্যে ব্যাপারটা আছে। আমি সাংঘাতিক রকমভাবে মিউজিক পেইন্টিং এগুলো শিখেছি। বিনোদিনী পর্যন্ত যা শিখেছি তারপর গত আড়াই বছরে অনেক কিছু ভুলে গিয়ে নতুন কিছু বিষয় শিখেছি। এমনকি বিনোদিনী নাটকটি আমি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তা না হলে নতুন কিছু আমি করতে পারবো না। প্রডাকশনের ব্যাপারে, বিশেষ করে নাটকের প্রডাকশনের ব্যাপারে নাটকের ভাষার দক্ষতা বাড়ানো উচিত। যদি এটা বাড়ে তবে এর প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে।
নিমজ্জনের মতো জটিল টেক্সট নিয়ে আমি যখন কাজ করতে গিয়েছি তখন নাটকের ভাষা নিয়ে অসম্ভব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে। নিমজ্জনের স্ট্রাকচারের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বাংলাদেশে প্রচলিত স্বাভাবিক নাট্য ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ নাটকে আমি এগোনোর চেষ্টা করিনি। তাহলে এটা সাদামাটা একটি নাটক হতো, স্টেটমেন্ট ধর্মী কাজ হতো। গল্পের কাঠামোর মধ্যে থিয়েটার ঢুকে যেতো। যদি গল্পের কাঠামোর মধ্যে ঢুকে যায় তবে সেখান থেকে বের করার উপায়টা কি? উপায় হচ্ছে, প্রথমেই গল্পটাকে অস্বীকার করা। তারপরও কিন্তু একটা স্ট্রাকচার তৈরি হয়। ঘর কতো রকমে বানানো যায়? ঘর তো ঘরই। লালন যেমন বলেছেন, শরীরের ভেতরে একটা অসীমতা আছে। তেমনি করে স্ট্রাকচারের ভেতরেও একটা অসীমতা আছে।
যেহেতু নিমজ্জন আমার শেষের দিকের কাজ। এতে আগের কাজগুলোর চেয়ে অনেক বেশি দুঃসাহসী হওয়া সম্ভব হয়েছে। আমি মনে করি, নাটক যদি নাটকের ভাষায় মঞ্চে নির্মিত হয়, যেটা বিনোদিনীতেও দেখা যাবে বা যে কোনো নাটকে। বিনোদিনীতে দেখা যাবে, নাটকের টেক্সটের প্রভাবের চেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নাটকীয় মুহূর্ত তৈরির জন্য নানাভাবে ভাষা প্রয়োগের একটা সাধারণ প্রবণতা আছে।

নাটকের ভাষা নিয়ে বলুন।

প্রত্যেকটা শিল্পমাধ্যমের আলাদা ভাষা আছে। পেইন্টিং যে আকা হয় তাতে রঙ, তুলি, ভাবনা, রেখা, বিন্দু এগুলো হচ্ছে তার ভাষা ও উপকরণ। সেটা দিয়ে পেইন্টিং তৈরি করতে হয়। মিউজিকে যেমন সা রে গা মা পা ধা নি সা। তারপর রাগের ব্যাপারগুলো আছে। সেগুলো আমাদের অ, আ বা এ বি সি ডির মতো নয়। কিন্তু সেগুলোও ভাষা। থিয়েটারে তেমনি করে এর অভিনয়, দেহ, টেক্সট, আলো মিউজিক সব মিলিয়ে একটা ভাষা নির্মিত হয়। এগুলো ঠিক আক্ষরিক অর্থে বলা যাবে না। এগুলো বোধ থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি হয়।
এখন স্টানিস্লাভস্কি, পিটার ব্রুক বা মায়ারহোল্ডের কথা যখন বলি বা ব্রেখটের কথা বলি তখন থিয়েটার ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করার প্রবণতা থেকে কিংবা থিয়েটার ব্যবহার করার প্রবণতা থেকেই কিন্তু একজন আরেকজনের থেকে আলাদা হয়ে ওঠেন। কেউ এগিয়েছেন বা কেউ ভিন্ন রকম কাজ করেছেন। সবাই এক রকম হননি। ব্রেখট যখন এলিয়েনেশন তৈরি করার কথা ভেবেছেন তখন স্টানিস্লাভস্কি সে রকম করে ভাবেননি। আবার এখন পিটার ব্রুক তার অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে অন্য রকম গভীরতায় চলে গেছেন।
তারা মনেই করছেন, থিয়েটার হলো ইমিডিয়েট থিয়েটার। এ মুহূর্তের থিয়েটার। এখনই হচ্ছে, এখনই শেষ। তারা মনে করছে, এম্পটি স্পেসের থিয়েটারের কোনো বিকল্প নেই। আমার মনে হয়, তারা সব সময়ই চেষ্টা করেছেন থিয়েটারকে গল্পের আড়ষ্ট কাঠামো থেকে বের করে নিয়ে যেতে। থিয়েটারকে আলাদা জায়গায় দাড় করাতে চেয়েছেন।
ছোট গল্প, বড় গল্প বা উপন্যাসের নিজস্ব ভাষারীতি আছে। ওই ছন্দ ও ভাষারীতিতে কি থিয়েটার এগুবে? না। আমরা চ্যালেঞ্জ করেছিলাম এ জায়গাটায়। এটা করতে গিয়ে অন্য ভাষা থেকে নেয়ার কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সেটাকে অবলম্বন করে যদি কাজ করি তবে আমার থিয়েটার আলাদা হবে না। থিয়েটার আলাদা শিল্প মাধ্যম হিসেবে দাড়াবে না। বাংলা থিয়েটারের জটিলতা এখানেই। সে তার ভাষা ব্যবহারে ব্যর্থ হয়েছে।

আপনি যে টেক্সট ব্যবহার করেছেন তার ভাষাও কিন্তু আলাদা। সেটা কি নাটকের ভাষা রীতিকে দাড় করাচ্ছে?

না। সেটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। নিমজ্জন কি শুধু ভাষারীতির ওপর দাড়িয়ে থাকছে? লেখ্য ভাষার ওপর আমরা নির্ভরশীল ছিলাম না। সব মানুষ কি বুঝেছে ইনকা মায়া থেকে, ইজিপশিয়ান সিভিলাইজেশন থেকে এ পর্যন্ত আসার পরিভ্রমণটা? এটা তাদের জানার প্রয়োজন নেই।
আমরা যারা নাটক করবো তাদের জানার প্রয়োজন আছে। আমাকে অনেকে বলেছে, দর্শক বুঝবে না। কিন্তু আমার আরেক বন্ধু বলেছে, দর্শক সব থেকে বেশি বুঝবে। আমি তার সঙ্গে একমত। আমি শোর আগে বলেছি, রমনার বটমূলের সেই হত্যাকা-ের দৃশ্য বা একুশে আগস্টের সেই ছিন্নভিন্ন পা আমাদের সবার অভিজ্ঞতায় আছে। যে ভূমিতে দাড়িয়ে আছি সে ভূমি কিন্তু রক্তাক্ত। তাহলে গণহত্যার চিত্র কঠিন হলে আমি কমিউনিকেট করতে পারবো না এটা ঠিক নয়।

নিমজ্জনে বহুদিন পর আপনি সিনিয়র কর্মীদের বাইরে গিয়ে নতুন কর্মীদের নিয়ে কাজ করলেন। কেন?

প্রথমত নিমজ্জন একটা কঠিন টেক্সট। সেলিমের ল্যাঙ্গুয়েজ আরো বেশি জটিল হয়েছে। সে আকড়ে ধরতে চাচ্ছে পৃথিবীর সব বিস্ময়গুলোকে। সব বিস্ময় ও ঘটনাগুলোকে সে আকড়ে ধরতে চাচ্ছে, আকড়ে ধরতে চাচ্ছে। ভাষার কারুকাজ করতে গিয়ে সেলিম টেক্সটটাকে কঠিন করে ফেলছে।
দ্বিতীয়ত সেলিমের কাব্যগত একটা কৌশল আছে। এটা সেলিমের একটা জাদুকরি ব্যাপার। এটা বুঝে থিয়েটারটা করতে হবে। যদি তাই করতে হয় তাহলে সেলিম যেমন এক হাজার বই পড়ে এ নাটকটা লিখেছে তখন আমাকে তো একশটা বই পড়তে হবে। ওই জার্নিটা আমাকে বুঝতে হবে, জানতে হবে। আমার দলের ছেলেমেয়েদের সেটা জানতে হবে। সেই জানার সময়টা আমাদের সিনিয়র আর্টিস্টদের নেই।
এছাড়া আমি প্রয়োগরীতি নিয়ে প্রথমে নিশ্চিত ছিলাম না যে, কোন প্রয়োগরীতি দিয়ে থিয়েটারটা করবো। কিন্তু আমার এটা মনে হচ্ছিল যে, যেহেতু নাটকের ভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের একটা সম্ভাবনা আমার এ নাটকে আছে সেহেতু আমি শারীরিকভাবে সমর্থ মানুষগুলোকে নির্বাচন করি। এখানে মনে হয়েছে, যৌবনের কোনো বিকল্প নেই। তারুণ্যের কোনো বিকল্প নেই। শরীরের দিক থেকে তারুণ্য নেয়ার দিক থেকে তারুণ্য।
তাদের শুধু অভিজ্ঞতাটা কম। এদের দিয়ে যদি আমি থিয়েটার করি তবে একদিকে আমি ফেইল করতে পারি। সে চ্যালেঞ্জটা আমাকে নিতেই হবে। কিন্তু যদি সাকসেসফুল হই তবে বাংলা থিয়েটারের একটা মোড় ঘুরে যাবে। প্রতিটা দলে এ সমস্যা আছে। তারুণ্যের প্রতিভা, তারুণ্যের সম্ভাবনাকে এক্সপ্লোর করা হচ্ছে না। প্রাচ্য নাটকটিতেও কিন্তু তরুণদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পুরনোদের মধ্যে যারা নিয়মিত তাদের আমি তরুণই মনে করি। আমার বয়স এখন ৫৭। আমি নিজেকে তরুণ মনে করি। আমার প্রতিদিনই জন্ম হয়, কারণ আমি থিয়েটার করি।

অনেক কাজ ও ব্যস্ততার মধ্যে আপনি সার্বক্ষণিকভাবে থিয়েটার করেন, এটা কিভাবে সম্ভব হলো?

মাথার মধ্যে অনেক চেম্বার থাকে। অনেক চেম্বার আমি শাট ডাউন করি। শাট ডাউন করি তারপর সে একা কাজ করে। আমার থিয়েটারের চেম্বারটা সব সময় খোলা থাকে। শুধু থিয়েটার নয়, শিল্প। কোনো গান শুনলেও আমি তাৎক্ষণিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি।

বিশ্ব নাট্যদর্শনের অভিজ্ঞতা নিমজ্জনে কিভাবে যুক্ত হয়েছে?

আমার ও শিমূলের বড় একটা আগ্রহ আছে বিশ্বের নানা দেশের পেইন্টিং ও সঙ্গীত নিয়ে। আমি পৃথিবীর সব দেশ না ঘুরলেও অনেক দেশ ঘুরেছি। সেলিম অনেক সময় বলে, নিমজ্জনের দুই বন্ধু আমি আর সেলিম। সেলিম হচ্ছে অসুস্থ বন্ধুটা আর আমি হচ্ছি বিশ্ব ভ্রমণকারী। এটা ঠিক নয়। সেলিম আমাকে বলেছে। আমাকে যখন নাটকটা দেয় তখনই বলেছে। আমি বিভিন্ন দেশ ঘুরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সেলিমকে বলেছি। ইতিহাস, আর্কিওলজি গণহত্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলাপ হয়েছে।
সেলিমের দুর্দান্ত একটা পড়ালেখা আছে। আসলে সেলিমের চোখ দিয়ে আমরা অনেক কিছু দেখি। প্রয়োগের দিক থেকে যদি প্রশ্ন আসে যে, কি করে এ প্রয়োগটা করতে পারলাম? সেখানে এখনকার টেকনলজিকে বুঝতে পারার ব্যাপারটা কাজে লেগেছে। প্রসেনিয়ামকে বুঝতে পারার ব্যাপারটাও আছে। শুধু প্রসেনিয়াম না অঙ্গন থিয়েটার হিসেবেও নাটকটা ভালো লাগবে। মঞ্চে শেডিউল সমস্যার কারণেই এ নাটকটা প্রসেনিয়ামে করতে হয়েছে। কিন্তু আমার প্রসেনিয়াম ভালো লাগে না। আমি এখনো মনে করি, আমি এটা এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে বা মহিলা সমিতিতে মাটিতে করবো। করবোই। তখন কালো ভূমির কালো রঙটা দর্শকের চোখে লেগে থাকবে। তার ওপর শাদা ফিগারগুলো চলাফেরা করবে। অথবা কালোর ওপর কালো ফিগারগুলো চলাফেরা করবে।
আমি স্বাধীন। কিন্তু যেহেতু সমস্যাগুলো আছে সেহেতু প্রসেনিয়ামের ভেতর আমাকে ঢুকতে হচ্ছে। আমার রাজনৈতিক একটা এক্সপোজার বহুদিন ধরে আছে। ছাত্রজীবন থেকে আমরা মার্কস-অ্যাঙ্গেলস, লেনিন থেকে গ্রামসি, চার্চিল কিংবা পরবর্তী পর্যায়ে আঁদ্রে মারলো থেকে শুরু করে এখনকার দেরিদা বা অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ কেউ বাদ যাচ্ছেন না।
আমাদের কিন্তু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে। আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভিয়েতনাম ওয়ার পেয়েছি। প্যালেস্টাইন হয়ে আমরা যেভাবে ইরাক ও আফগানিস্তানে পৌছেছি সেখানে আমাদের ধ্বংস ও হিংসার অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের বিশ্ব অভিজ্ঞতা ইতিহাস থেকে নেয়া। এ অভিজ্ঞতা আছে আমাদের উপস্থিতির মধ্যে। কাব্যগতভাবে আমার যে ট্রেজারটা আছে বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্যে। যেহেতু এ দুটি ভাষাতেই আমি পড়তে পারছি। সেটার ভেতর দিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ওয়ার অ্যান্ড পিস ও আনা কারেনিনা থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। গ্যেটের ফাউস্ট থেকে যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে তাতে মেফিস্টোফেলিসের সঙ্গে বুশের বা লাদেনের তুলনা করতে আমার খুব একটা অসুবিধা হয় না। এ অভিজ্ঞতা শিল্পে কিভাবে এলো সেটা একটা জটিল প্রশ্ন।
আমাকে অনেকেই গত তিনদিন ধরে প্রশ্ন করছে যে, আপনি এ নাটকটা কিভাবে করলেন? আমি আসলে জানি না। জানলে বলে দিতাম কি করে করেছি।

নাটকের টেক্সট থেকে আমাদের আশঙ্কা ছিল এ নাটকের বীভৎসতা ও ভয়াবহতা হয়তো দর্শক গ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু যখন নাটকটা দাড়ালো তখন আমরা দেখলাম, বীভৎসতাকে ছাপিয়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য সামনে এলো। কোরিওগ্রাফি, লাইট, আলো ইত্যাদির মাধ্যমে।

আমার যে কোনো কাজের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হচ্ছে আমি একটা সৌন্দর্য ধরার চেষ্টা করি। বনপাংশুলের প্রদর্শনীতে বলেছি, আপনারা আদিবাসীদের যে সংগ্রামের কথা বলেন আমিও সেটা বলেছি। এগুলোর চেয়ে বেশি আমি যে মেসেজটা আপনাদের দিতে চাই সেটা হলো এরা সুন্দর মানুষ। এদের ধ্বংস করবেন না। আমি যদি স্টাবলিস করতে পারি আদিবাসীরা সুন্দর মানুষ আমরা যেভাবে বলি সে রকম জংলি নয়। ওর ভেতরের বিউটি যখন আবিষ্কৃত হবে তখন ওকে আমার চেয়েও ভালো মানুষ বলে মনে হবে। আমার মনে হয়, বনপাংশুল সে কাজটা করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং আমার নাটকের মূল লক্ষ্য সুন্দর একটা ভূমিতে ল্যান্ড করা।
নিমজ্জনে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ব্যবহার যেভাবে করেছি সুর-তাল ঠিক রেখে লয়টা চেঞ্জ করে দিয়েছি। ইনডিয়ার প্রফেসর অরুণ সেন আমাকে বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের ছাপ আমার ভেতর আছে। ঋত্বিক ঘটকের চেয়ে ভালো রবীন্দ্রনাথের ব্যবহার কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। এ নাটকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের যে ব্যবহার হয়েছে তা আর কোথাও এভাবে হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
আরেকটা হলো কস্টিউম। সাদা ও কালো স্টকিং শুধু ব্যবহার করা হয়েছে। সেলাই বিহীন কাপড়। নিউট্রালিটি নিয়ে আসা হয়েছে। ছেলেমেয়েদের সাদা আর কালো কাপড়ের মাধ্যমে আদি মানুষের মতো করে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ডিজাইন শিমূল করেছে। এই কস্টিউমের মাধ্যমে আমরা সময় ও জাতি নিরপেক্ষতার ব্যাপারটা দেখাতে চেয়েছি। এ পোশাকে কুশীলবরা প্রতিবাদ করার জন্য বা স্টেটমেন্ট দেয়ার জন্য দাড়িয়েছে এটা সহজেই মনে হবে।
যেহেতু নাটকে কোথাও লেখা নেই এটা কোথায় হচ্ছে, বাংলাদেশ, নিকারাগুয়া, কায়রো নাকি টোকিও। কোনো স্পেসের উল্লেখ নেই। যেন একটা স্পেসে একটা টেবিলে সব গণহত্যাকে এনে হাজির করা হয়েছে। সেখানে কোন কস্টিউম ব্যবহার করা হবে। যে কস্টিউম মানুষের কস্টিউম, কোনো জাতির কস্টিউম নয়। এ আন্তর্জাতিকতাটাকে আমরা অ্যাচিভ করতে চেয়েছিলাম।
আমি বলছি না শেকড়কে অস্বীকার করে আন্তর্জাতিকতা। আমার শিল্পের ভূমিতে আছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে ভিত্তি ধরে হাত বাড়িয়েছি ওপরের দিকে। তাকে বুকের মধ্যে রেখেই হাত বাড়িয়েছি। সিম্পলিসিটি অফ স্টালাইজেশন অফ কস্টিউম, মিউজিক অ্যান্ড অ্যাকশন। প্রক্রিয়াটা কিন্তু জটিল। ঢালী আল মামুনের অসাধারণ সেট এটাকে সহজ করেছে। এই প্রথম ভিডিও প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়। এটা ব্যবহার করা হয়েছে, বিমূর্ততা থেকে বেরিয়ে শিল্পের অভিজ্ঞতাকে সঞ্চারিত করার কাজে।
আরেকটা জায়গায় গুয়ের্নিকার ইমেজ ব্যবহার করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে গুয়ের্নিকা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। এটা করা হয়েছে। কারণ গুয়ের্নিকার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। আমি কিন্তু বাস্তবে কোনো বাস্তব চিত্রের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি না। প্যারালাল শিল্প অভিজ্ঞতা তৈরির জন্য এটা করছি।

নিমজ্জন থেকে মনে হচ্ছে, কনভেনশনাল নির্দেশকের জায়গা থেকে সরে এসে ফিল্মের ডিরেক্টরের অবস্থানের কাছাকাছি অবস্থান করছেন আপনি।

ডেফিনেটলি ফিল্ম ও নাটক দুটিই কিন্তু ডিরেক্টরস মিডিয়া। গান কিন্তু সিঙ্গার্স মিডিয়া। যতো ভালো গান কেউ লিখুক বা সুর করুক সেটা কিন্তু শিল্পীরই। বাংলাদেশের মঞ্চে নির্দেশকের ভূমিকা গৌণ ছিল বলেই কিন্তু থিয়েটার দাড়াচ্ছিল না। বহুমাত্রিক ভাবনা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। আমার তিন যুগের অভিজ্ঞতা ও হাজার বছরের থিয়েটারের একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে আমার উপলব্ধি এমন যে, থিয়েটার নব আবিষ্কৃত মাধ্যম দ্বারা চ্যালেঞ্জনড হয়েছে। কিন্তু মানব জীবন প্রবাহের সঙ্গে নিগূঢ়ভাবে সম্পৃক্ত এ শিল্প মাধ্যম এক জাদুকরি কৌশলে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং আত্মীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নব জীবন লাভ করেছে।
টেকনলজির এ যুগে থিয়েটার তার ভাষার সঠিক ও সুচারু প্রয়োগ ঘটাতে টেকনলজিকে আত্মীকরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবন যখন এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে থিয়েটারকেও এগিয়ে যেতে হবে। অনেক শিল্পমাধ্যম কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছে। হারিয়ে গেছে অনেক অভিনয় রীতি। আজকের মধ্যবিত্ত কিন্তু টেকনলজির ভেতর বসেও শেকড়কে অনুভব করে। কিন্তু আমরা শিল্পীরা সংযোগটা ঘটাই না। আমাদের ব্যর্থতা এখানে। আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের কোনো সংঘাত নেই। নিমজ্জন যে বাকটা ফেরাতে চেয়েছে আমাদের নাট্য ও শিল্প জগৎ যদি সেটাকে গ্রহণ করে। যদি বাকটা সঠিকভাবে ফেরানো যায় তবে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।

Wednesday, June 06, 2007

জিসম # মাহবুব মোর্শেদ

শরীর বিষয়টি শুরু থেকে আমার জীবনে ভীষণ আলোচ্য একটি প্রসঙ্গ হয়ে থাকলো। এ বিষয়ে অবশ্য আমার গুরু সৈয়দ আমাকে মাঝে মধ্যে বকাবাদ্য করেন। তিনি তরুণদের বিশাল অংশের মেয়েদের উরুতে হাত রেখে জীবন অতিবাহনের বেদনায় ব্যথিত। এদের যে সমাজ-সভ্যতায় কোনো অবদানই রইলো না এ নিয়ে তার আফসোসের কমতি নাই। আমি তর্কের খাতিরে গুরুর সাথে তর্ক করি। নইলে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটা অধীনতামূলক মিত্রতা হয়ে পড়ে। সম্পর্কের ডায়ালেকটিকসটা ফোটে না। বলি, কী কও গুরু, আমি তো দেখি শরীরেই আরাম। সব শাস্ত্র ঘেঁটে এসে হে পণ্ডিত, নারীতে আরাম। গুরু কয়, এইটা কী কইলি? জীবনের অভিজ্ঞতার কথা যদি ধরিস, তবে বলি, তোদের বয়সে নারীর শরীরকে মনে হইতো শরাবান তহুরা, বেহেশতের শরাবের নদী; সে শরাব আমি গেলাসে গেলাসে পান করেছি। এখন কী মনে হয় জানিস? স্রেফ একটা চকলেট-লজেন্সও যদি মনে হইতো, তাহলেও হইতো। আমি বলি, তবে তো সেই একই ঘটনা ঘটলো গুরু। যুগে যুগে গুরুরা শিষ্যকে একই কথা বইলা আসলো আর শিষ্যরাও থোড় বড়ি খাড়া... গুরুর যৌবনকালের দিকে ধাবিত হইলো। আমি একটা কথা কই গুরু, যদি কিছু মনে না নেও তবে সত্য হইলো ওইটা তোমার প্রৌঢ়ত্বের সত্য আর এইটা আমার যৌবনের সত্য। যুগে যুগে গুরুরা ওই এক কথা কইয়া গেল। আর শিষ্যরাও উল্টাপথে মদন রসে মন মজালো। গুরু বুঝে, আমি যা বলি তাই করি। তাই তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কন এই কারণেই পৃথিবীটা এইখানে আইসা পৌঁছাইলো। আমি দেখলাম গুরু হতাশ। এটা সহ্য হওয়ার নয়। তাই এইবার গুরু-শিষ্য মিলে পৃথিবীর বর্তমান ভোগবাদীতাকে গালাগাল করতে থাকি। এই ফাঁকে পাঠিকাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি আমার নাম রাকেশ, গুরু বলেন রাস। আর গুরুর নাম সৈয়দ, আমি কিছু বলি না। গুরু গৌরবর্ণ, চক্ষু বড় গোলগোল চকচকে, হাইট ভালো, আমি আর গুরু যখন রাস্তায় হাঁটি তখন মনে হয় গুরু দোতলা বাসের ছাদ থেকে কথা বলছে। এই নিয়ে লোকে রঙ্গ-তামাশা করে। তা করুক, তথাপি গুরুর একটা জিনিস কিন্তু লোকে তেমন একটা জানে না। সবাই ভাবে তিনি আমার অ্যাবনরমাল ফ্রেন্ড, উনি বিদ্বান ব্যক্তি, অমায়িক, মিশুক। আর পারতপে যৌন বিষয়ে হয়তো একটা কথাই তাদের মনে হয় যে, আমার গুরুর ধোন নাই। বন্ধু-বান্ধব জিজ্ঞেস করে তোর সৈয়দের বয়স কত? সঠিক বয়স বলতে গুরুর নিষেধ। এমন কি সাল-বিহীন জন্ম-তারিখও বলা চলে না, তাই বলি এ্যারাউন্ড ফিফটি। তবে তো ওনার খাড়ায় না, কি বলিস? এই কথার সদুত্তর হয় না। কিন্তু মোম একটা উত্তর দিতে হয়, তাই বলি ‘যাইও’। গুরুর যেসব বিষয় লোকে জানে না সেগুলো একে একে বলি।
তারও আগে বলা দরকার এই গল্পের ভূমিকাটা কী। অর্থাৎ কী বিষয় নিয়ে এই গল্প তৈরি। সে ২০০৩ সালের জুন মাসের কথা। আমার জীবনে একটা ভয়ানক প্রলয় উপস্থিত হলো। সামান্য একটা ভুলের জন্য সমস্ত বন্ধু আমাকে ছেড়ে দিলো। ঘটনা কিছুই না, এক পার্টি-ফার্টি কিছু হবে। জেলা শহরেও আজকাল এগুলো হয়। ড্রিঙ্কস কিছু ছিল। ড্রিঙ্কস করলে আমি একটু জ্ঞানী-জ্ঞানী কথা বলি, তাই বন্ধুরা আমাকে ওভারডোজ করে দিলো। আমার তখন হঠাৎ একটা হিন্দি গান মনে পড়ে। সবলোগ পিতে হ্যায় শরাব পানি মিলাকে, ম্যায় তো পিতে হুঁ শরাব জওয়ানি মিলাকে। বন্ধুরা ওয়াহ ওয়াহ করে উঠলে আমার উৎসাহ বেড়ে যায়। প্রাসঙ্গিকভাবে বলে রাখি, পার্টিতে বন্ধু-স্ত্রীরাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উপস্থিত ছিল। মফস্বলের মেয়েরা এইসব ব্যাপারে একটু বেশি ফাস্ট। ওই হিহি হো হো আর খোলামেলা পোশাক-আশাকে। আসরটাকে আমি হিন্দি সিনেমা নাকি হলিউডি সিনেমাই ভাবলাম জানি না। একে তো মদের ঘোর অন্যদিকে মহিলাদের সেক্সি আউটলুক। মরার ওপর খাড়ার ঘা। হাতের কাছে এক বন্ধু পতœীকে পেয়ে কিস বসিয়ে দিলাম। আর যাবে কোথায়? ওই ঝাকানাকা ফাস্ট মেয়েও ফোঁস করে কেঁদে দিলো, তার স্বামী মদের বোতল বাগিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসলো। পার্টি ফার্টি লাটে উঠে বিচার সভা বসলো। আমার গরম মাথা হিম হয়ে আসলো। এই মুহূর্তে সেটা অসঙ্গত বিধায় আমি যারপর নাই মাতলামি করতে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত আমাকে মাতাল অবস্থায় মাফ চাইতে হলো, আর আমি যেহেতু অবিবাহিত, তাই এইসব আসরে আমাকে নিষিদ্ধ করা হলো। সেই থেকে আমি বন্ধুবিহীন। এবং সবার অলে গা ঢাকা দিয়ে শহরে থাকি। বেনাপোল থেকে একটা ইন্ডিয়ান ভিসিডি প্লেয়ার আনিয়ে সারাদিন হিন্দি-বাংলা-ইংরেজি ছবি দেখি, গান শুনি। টিভিতে ডিশের লাইন আছে। সারাদিন চ্যানেল ঘুরাই আর বিড়ি-সিগারেট ফুঁকি। সেক্সের ধান্দা বাদ, তলে তলে বয়স তো আর কম হলো না। এই বয়সে এত ঝক্কি আর সইতে পারি না। তাই হাত মেরে যা হয় তাতেই সই। এইভাবে জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর গেল।
আমি জ্ঞান পিপাসু। যা হওয়ার তাই হলো বর্তমান সিনেমা-বাজার নিয়া আমার বিস্তর জ্ঞান জমলো। জ্ঞানের একটা নিজস্ব ধর্ম আছে একটুখানি জমলেই তা পেটের বাহির হওয়ার জন্য আকুপাকু করে। কী করি কী করি। কেউ আমার দিকে ফিরে তাকায় না। হয়তো ভাবে, লোকসমে যদি তুমি চুমু খাইতে পারো তোমার কাছে আড়ালে ভদ্রলোকের বউ ছেড়ে দিলে কী হবে? আমি এইটুকু বলার অবকাশ পাই না যে ভাই আমি অতো খারাপ লোক না।
এই খারাপ সময়ে আমার জীবনে সৈয়দের আবির্ভাব। কোন বংশের সৈয়দ কে জানে। সন্ধ্যাবেলা মনটা এমনিই একটু আকুপাকু করে তাই মাঠের মধ্যে বসে ছিলাম। চারদিকে হালকা অন্ধকার। গোধূলির আলো মিলিয়ে যাবে যাবে। এমন সময় ফাঁকা মাঠে আমার সামনে অপরিচিতি এক ব্যক্তির আবির্ভাব। বলে, আপনার মধ্যে তীব্র যৌন আতৃপ্তিবোধ আছে। আমি ভাবলাম, কে এই ব্যক্তি যে একেবারে চিন্তার গভীরে সেঁধিয়ে যায়? হতচকিত হয়ে তার দিকে তাকাতে চাইলাম কিন্তু অন্ধকারে মুখ দেখা গেল না। রবীন্দ্রনাথের মণিহারা গল্পটির কথা মনে পড়ে গেল। আমিও তাকে পরখ করে নিতে চাইলাম। কোনো কথা বলে চুপচাপ তার দিকে তাকালাম, তারপর আবার আগের মতো উদাস বসে থাকলাম। জীবনে এত ঘাট মাড়িয়েও এত বন্ধু এত প্রেম তবু তৃপ্তি এলো না তো? ভেবেছিলেন আপনার মতোই আশপাশের দুনিয়া দেখলেন তা নয় এখন একা এই মাঠে বসে ভাবছেন জীবনের তবে কী মানে আছে? গা ঝাড়া দিয়ে উঠুন। শিড়দাঁড়া টানটান করে দাঁড়িয়ে পড়–ন। সত্যি বলতে কী, একটা বল পেলাম যেন তার কথায়। বললাম, আপনি কে? কী আপনার পরিচয়? উনি বললেন, আগে আলোয় চলুন। সেই পরিচয় সৈয়দের সাথে।
প্রথম দিনেই গুরু মানলাম। সম্বোধনে সে দুই ধাপ আমি একধাপ নিচে নামলাম। তুই-তুমি। মাঝে-মধ্যে অবশ্য ফাকচুয়েট করে। তুই-তুমি। তুমি তুই। হাজার হলেও গুরু বলে কথা। সৈয়দের মানসকাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সে ২৫% আইডিয়ালিস্ট + ১৫% লিবারেল ডেমোক্রেট + ১০% উপযোগবাদী + ৩০% বন্ধু অন্তপ্রাণ + ১০% অলস + ৫% শরীরী + ৫% স্বার্থপর। পড়াশুনায় ভয়াবহ সামন্ততান্ত্রিক। আমার ব্যাপারে সৈয়দের মূল্যায়ন হলো আমি ৫০% শরীরী + ২৫% অশরীরী + ২৫% মার্কসবাদী।
মার্কসবাদ কী জিনিস আমি জানতাম না। সৈয়দই প্রথম আমাকে মার্কসবাদ বিষয়ে জানালো। এরকম একজন আধা-বুর্জোয়া আধা-সামন্তবাদী কিভাবে আমাকে মার্কসবাদের মতো বিধ্বংসী দর্শনের খোঁজ দিতে পারলো এখন আমি ভেবে অবাক হই। পরিচয়ের সপ্তাহ কি পকাল পরে একদিন গুরুর বাড়িতে গেলাম। বাড়ি দেখে তো আমার চু চড়কগাছ। গ্রন্থময় এক বাড়ি। দান্তে, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, গ্যাটে, শেক্সপীয়র, রবীন্দ্রনাথ এইসব লেখকের খণ্ড খণ্ড ভরা। টীকাভাষ্য, উপনিষদ, বাইবেল এগুলাও আছে। এক কথায় বলা যায় সমাজের আধুনিক যুগে প্রবেশের পরের আর কোনো বই তার বাড়িতে ঢোকেনি। যাই হোক, আমি বিস্মিত এবং খানিকটা হতোদ্যম হয়ে পড়লাম। লাঞ্চের পর তাকে ধরলাম, গুরু কাসিক পড়ো ভালো কথা, কিন্তু এত হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে আধুনিক যুগের সাহিত্যের ছিটেফোঁটাও নাই এইটা কেমনে হয়? গুরু বলে, সবটা এতেই আছে। অর্থাৎ কিনা আধুনিক সাহিত্যে যা আছে, এগুলোর মধ্যেও তাই আছে। সত্যি কথা বলতে কি, শিল্প বিপ্লবের পর পৃথিবীতে ক্রিয়েশন বলতে কিছু হয়নি। সবই এন্টারপ্রেটেশন। আমি খোঁচানোর জন্য বললাম তুমি ভীষণ সামন্তীয়। এইটুকু বলে আমি থামলাম কেননা এইতো তার সাথে শেষ কথা নয়। আর একটা কথা। একটু পড়াশোনা না থাকলে আলাপ ঘন হয় না।
যাই হোক, সৈয়দের মাধ্যমে আমার সিনেমা-জগতে দাসযুগ আর সামন্তযুগের কিছু বইয়ের অনুপ্রবেশ ঘটলো। রীতি অনুযায়ী আমার বাড়িতেও সে এক দুপুরে লাঞ্চে আসলো। আমার সংগ্রহে অসংখ্য সিডি দেখে তারও চু চড়কগাছ। বয়স হয়েছে। তবু যৌবন, যৌনতা ও ফ্যান্টাসির এই অসামান্য উৎসার কার না ভালো লাগে। তাকে আমি জিসম ছবির কথা বলি। বলি যে, জিসম মানে হলো শরীর। এ ছবিটা সামনে মুক্তি পাবে। এতে অভিনয় করবেন বোম্বের টপ মডেল বিপাশা বসু। ধারণা করা হয় শি ইজ ওয়ান অফ দ্য সেক্সিয়েস্ট এ্যান্ড মোস্ট সেনসুয়াস গার্ল ইন দ্য অরিয়েন্ট। উই আর ওয়েটিং ফর হার লেটেস্ট আউট-বার্স্ট। সৈয়দ বলে তুমি আছ পুঁজিবাদের প্রোডাক্টের রিয়েলিটির জগতে। ইট ইজ সাম শর্ট অফ হাইপার-রিয়েলিটি। এখন তোমার আর আমার বন্ধুত্ব হইতে হইলে দরকার মার্কস আর এ্যাঙ্গেলস। প্রোডাকশন রিলেশন বুঝতে সেই থেকে আমার প্রগতি প্রকাশনীর বই পড়া শুরু। আমি বই আনি, গুরু সিডি নিয়ে যায়। এইভাবে আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ওঠে। একদিন আমি ভাবি এই যে অসম বন্ধুত্ব, এইটা কেন? সৈয়দকে একটা পরীা করা যাক তো। তো, একদিন আমি রাত্রে তার বাসায় থাকি। পরীা করি ছেলে ছোকরার পাছা মারার তাল আছে কিনা। এই বয়সে এমন ভীমরতি দেখা দিতেই পারে। বলাবাহুল্য সৈয়দ পরীায় উত্তীর্ণ হলো। এখানেও সে আইডিয়ালিস্ট। মেয়ে ছাড়া লাগায় না। এরপর তার সাথে আমার যৌন বিষয়ে খোলামেলা কথাবার্তা হতে শুরু করলো। আমি আমার হিস্ট্রি বললাম। সে বললো, আমি তোমারে আর হিস্ট্রি আর বলি না। বরং আসো আমরা একটা সাইকোলজিক্যাল গেম খেলি। তোমারে আমি আমার এক পুরানা বন্ধুর কাছে নিয়া যাই। তুমি ওর কাছ থেকে আমার হিস্ট্রির একটা অংশ জাইনা নাও। তবে শর্ত থাকে, তুমি জেলাস হইতে পারবা না। এই কথা হয়ে থাকলো। তথাপি আজ যাই কাল যাই করে করে তার বন্ধুর বাড়ি আর যাওয়া হয় না। আমিও সৈয়দকে ভরসা রেখে এদিক সেদিক একটু ভাগ্য টেস্ট করতে থাকি। গুরু মধ্যযুগ থেকে এক নায়ককে ধরে এনে আমার সাথে তুলনা দেয়। বলে, এই খাই-খাইপনার নাম হলো ডন জুয়ানপনা। গুরুর ভর্ৎসনায় আমার মন কঠিন হয় না। মেয়ে দেখলে মাল মাথায় ওঠে। ভদ্রলোকের স্ত্রী-কন্যা কেউই বাদ যায় না। এই দেখে ভদ্রলোকেরা আমার কাছ থেকে ১০০ হাত দূরে থাকে। পারতপে আমার সাথে তাদের স্ত্রী-কন্যার পরিচয় করায় না। আমার এই গতিক দেখে গুরু ব্যথা পায়। বলে, রোসো। এইভাবে ক্রিয়েটিভিটির বারোটা বাজানোর অধিকার তোমার নাই। একটা উদ্বেগবিহীন সেক্সুয়াল লাইফ দরকার তোমার। চলো, কালকেই তোমারে আমার বন্ধুর বাড়ি নিয়া যাই। উদ্বেগবিহীন যৌনজীবনের সাথে বন্ধুর বাড়ির সম্পর্ক কী। গুরু বলে, রোসো।
গুরুর পীড়াপীড়িতে একদিন তার সঙ্গে শহরের দণি দিকে রওনা হলাম। ধরা যাক, তার বন্ধুর নাম রেবেকা বা লতা। আসল নাম এখানে উহ্য থাক। অবশ্য তাতেও কিছু আসে যায় না। পাঠিকারা অবগত যে গল্প গল্পই। যথারীতি পুরানা ধাঁচের বাড়িটিতে আমরা ঢুকে পড়লাম, বসবার ঘরে বসেও পড়লাম। ততোদিনে জিসম ছবিটি আমার দেখা হয়ে গেছে। দেখলাম সাাৎ বিপাশা বসু হেঁটে আসছেন।
আমার নাম লতা।
সৈয়দ বলল, ও বন্ধু; আমি বললাম, রাকেশ।
সৈয়দ প্রথমেই একটা গভীর পাঁচ মিনিটের চুমু এবং আমার সামনেই লতার দুধ থেকে নিয়ে পাছা পর্যন্ত হাতিয়ে ফেললো।
এরাউন্ড ফোর্টি। বোঝার উপায় নাই। ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ। আমার অবস্থা বলার মতো নয়। লতা না রেবেকা না বিপাশা আমাকে ইঙ্গিতে বসতে বললেন এবং সৈয়দের গাল কামড়ে একেবারে লাল করে ফেললেন। হঠাৎ তাকে ছেড়ে আমার দিকে নজর দিলেন। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন। কোথায় থাকি কী করি ইত্যাদি। সৈয়দ ততোণে দাঁড়ানো থেকে সোফায় বসে পড়েছে, লতা না বিপাশা না রেবেকা দাঁড়িয়েই ছিলেন আলুথালু বস্ত্রে। গুরু তাকে হোতকা টান মেরে কোলে বসালেন। একটানে ব্লাউজ খুলে নিপল চুষতে আরম্ভ করলেন। উনিও খুব সিরিয়াসলি আমার সাথে কথা চালিয়ে যেতে থাকলেন। আমার তখন মৃত্যুময় অবস্থা। এর চেয়ে আমাকে উলঙ্গ করে রডের বাড়ি দিলেও হতো। আমি জানুয়ারি কি ফেব্র“য়ারির শীতে ঘামছিলাম আর কাঁপছিলাম। ভেতরে শ্বাসকষ্ট টের পাচ্ছিলাম এবং মনে হচ্ছিল আমি তুনি মারা যাব। তারা যখন আরও ব্যস্ত হয়ে পড়লো তখন আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। বিশাল ফাঁকা বাড়িটিকে আমার একটা ডাইনির বাড়ি বলে মনে হলো। যে ডাইনি শুধু পুরুষের রক্তই পান করে চলে ক্রমাগত। আমি স্তম্ভিত, নির্বাক ও স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত হয়ে কতণ দাঁড়িয়েছিলাম জানি না। সৈয়দ আমার ঘাড়ে হাত রাখলে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। তার দিকে তাকাতে পারলাম না। ফিরতে ফিরতে বলেছিল, এতো আধুনিক ছেলে তুমি। সিনেমা দেখ, এক্স-ফেক্স কিছু বাদ দেও না। দেখলা তো সইতে পারলা না। জেলাস হইলা। শোনো, তোমারে তিনটা কথা বলি
ক. শরীরের বাস্তব ও অধিবাস্তব এক ব্যাপার নয়। তোমার শত-সহস্র হাইপার-রিয়েল চর্চা তোমাকে শরীরী মূল্যবোধের বাইরে টেনে আনতে পারে না।
খ. শরীর এমন এক দুর্গ যা সব সময় মরচে পড়া তালা দিয়ে বদ্ধ থাকে। যার চাবি কখনোই তুমি খুঁজে পাও না। দুর্গে ঢুকতে হলে তালা ভাঙতেই হয়। এ এমন এক দুর্গ কেউ নিয়মিত যাতায়াত করলেও তা তালাবদ্ধই থাকে অন্য সবার কাছে। অন্য কেউ পুনরায় তালা ভেঙে ঢুকে পড়লে দুর্গ কিছুতেই আর তোমার থাকে না।
গ. শরীর সব সময়ই ঈর্ষা, ক্রোধ, হিংসা, জিঘাংসা আর জুগুপ্সার বসতি।
আমি তর্ক করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। সত্যি কথা বলতে কি তার কথার প্রতিবাদে আমি কেঁদে ফেললাম।
সৈয়দ বলল, আমার সাথে চল। তোকে আজ এক অদ্ভূত জিনিস পড়তে দেব। ভেবেছিলাম সে আমাকে মার্ক্যুইস দ্য সাদ পড়তে দেবে। কিন্তু খাওয়ার পর রাত্তিরে তার রিডিংরুমে সে যে গল্পটা আমাকে পড়তে দিলো তা হলো ক্রোয়েটজার সোনাটা। গুরু ওষুধ জানে। আমার মাথা এক্কেবারে ঠাণ্ডা হয়ে এলো।
পরদিন ভোরবেলা সৈয়দ আমাকে জাগিয়ে তুললো। অত্যধিক শীতের সকাল ছিল সেটা। সৈয়দ পথ্যও জানে ভালো। গরম কফিতে একটু ব্রান্ডি মিশিয়ে খেতে দিল। তাতে আমার চেতনা ভেতর থেকে সাড়া দিলো। আমি গুরুর দিকে তাকালাম। সে ইতিমধ্যে স্নান সেরে নিয়েছে। বললো, রাকেশ আসো আমরা একটা গেম তৈরি করি। খেলাটা এই যে তুমি জীবনের যে জায়গায় আছে সেখানে আমি পৌঁছাবো আর আমি যেখানে আছি সেখানে তুমি আসবা। ধরা যাক, মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এইটা রেবেকার শরীর। আমি সেখানে পৌঁছে গেছি। তুমিও পৌঁছাও। আসো আমরা পরস্পরকে ক্রস করে স্থান বদল করি।
আমি বুঝি গুরু কী বলতে চায়। আমার সেক্সুয়াল লাইফে এটা নতুন ঘটনা। গুরু কি দেবতা নাকি? একবার পজিটিভলি ভাবি আবার পিছিয়ে আসি। নৈতিকতায় আঘাত লাগে। শেষমেষ বলি, এইটা কী কইলা গুরু। উনি তোমার বন্ধু। আমার শ্রদ্ধার পাত্র, তুমি পাগল হইয়া গেছ। আমার সামনে আর এই ধরনের কথা বলবা না। তুমি বরং এক কাজ করো, আমারে কিছুদিন মার্কসবাদ শেখাও। কম্যুনিজমে দীা দেও।
দেখলাম গুরু রাজি। তাই পরবর্তী তিনমাস আমরা কম্যুনিজম চর্চায় ব্যস্ত থাকলাম। গুরু মার্কস-এঙ্গেলসের নির্বাচিত কিছু বই আমাকে পড়তে দিলো আর সপ্তাহে সপ্তাহে পাঠচক্র শুরু হলো দু’জনের। আমরা যথাক্রমে পুঁজির বিকাশ, প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা, উদ্বৃত্ত-মূল্য, সর্বহারারা একনায়কত্ব, জগৎ পরিবর্তনের উপায়, তত্ত্ব ও চর্চা, পার্টি ও ব্যক্তি, বিপ্লবী লড়াইয়ের আবশ্যিক শর্ত ইত্যকার বিষয়ে আলোচনা করলাম। সৈয়দকে দেখলাম এই আলোচনার ফাঁকে তরুণ সমাজের উপর মহাবিরক্ত। এরা দুনিয়াটাকে চেঞ্জ করতে চায় না বুঝলা? এরা চায় শরীর। মেয়ে মানুষের উরুতে হাত রাইখা তিন তিনটা জেনারেশন চইলা গেল। কিছুই হইলো না। সব আফিমে ডুইবা রইলো। শরীরের বাইরে এরা দুনিয়াটাকে দেখলো না। তুইও তাই। বলি, সময় থাকতে শরীরটাকে ছাপায়ে ওঠ। আমি বুঝি, গুরু আমাকে আড়ালে আবডালে নেগেশান অব নেগেশান দিয়া রেবেকার শরীরের দিকেই টানে। কিন্তু আমার নৈতিকতা সায় দেয় না।
একদিন আমি সৈয়দকে বলি অনেক তত্ত্ব তো বুঝলাম। আসো এবার প্রাকটিস শুরু করি। পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করি।
ভালো কথা। পার্টি কী?
বিপ্লবের অগ্রগামী অংশ। শ্রমিক শ্রেণীর সহযোগী একটি পাতিবুর্জোয়া দল। শ্রেণীগতভাবে যারা নিজ শ্রেণীকে খারিজ কইরা আসে।
হইলো না। পার্টি হইলো একটা সম্পর্ক। অসংখ্য মানুষের সম্পর্কের সূত্র হইলো পার্টি। দুইজনে পার্টি হয় না। গঠন করলেই পার্টি হয় না। দুই থেকে তিন তিন থেকে বহুতে যাইতে হয়। এখন কথা হইলো তুই দুই থেকে তিনে যাইতে রাজি কিনা।
হ রাজি।
তাইলে রেবেকারে রিক্রুট কর। দেখা যাক, আমাদের তিনজনের পার্টি কেমন জমে?
এ কথায় আমার হাড়গোড়সহ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। আমি ভেবেছিলাম আমার প্রসঙ্গে গুরু রেবেকার কথা ভুলে গেছে। কিন্তু এই কথায় আমি নতুন করে অস্বস্তিতে পড়ে যাই। সে বলে
তুই আছস কনসেপচ্যুয়ালি পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পণ্যতাড়িত অবস্থায়। আমি আছি আধাসামন্তীয় আধাপুঁজিবাদি অবস্থায়। রেবেকা নারী। অবশ্যই নিপীড়িত গোষ্ঠীর সদস্য। তাকে আমাদের সঙ্গে আনতে হবে। আমাদের তিনজনের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
আমি কেমনে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাই? মনু বলেছেন, কুত্রাপি গুরুপতœীর সাথে প্রেম করবা না। এ অবস্থা হলে তো সৈয়দ আমার গুরু থাকে না। সে আমার মার্কসবাদের গুরু।
পরের এক সপ্তাহ আমি গুরুর সাথে দেখা করিনি। আমার ব্যক্তিগত গুহার মধ্যে আত্মরতিতে মগ্ন হয়েছিলাম। সারা দিন টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে এক সপ্তাহ পার করে দিলাম। হঠাৎ এক সকালে সৈয়দের বাড়ির সামনের চায়ের দোকানদার আমার বাড়িতে এসে হাজির। কী ঘটনা? সৈয়দ সাহেব ভীষণ অসুস্থ, আপনাকে যেতে বলেছে। সাথে সাথে বেরিয়ে পড়লাম। দেখলাম সে সত্যি অসুস্থ এবং মৃত্যুশয্যায় শায়িত। মুখ তার রক্তশূন্য, চোখগুলো কোটরে পৌঁছে গেছে। তার শীর্ণ একটা হাত হাতে নিয়ে মুঠোর মধ্যে ভরে ফেললাম। এতো তাজা লোকটার এই হাল? তবে কি ভিতরে দীর্ঘদিন ধরে কোনো ভয়াবহ অসুখ ছিল?
গুরু ইশারায় আমাকে তার আরো কাছে সরে যেতে বললো। ফিসফিস করে বললো যা রেবেকাকে নিয়ে আয়। ওর বাড়িটা চিনতে পারবি? আমি তার কথায় সায় দিয়ে উঠলাম। এতটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম যে ওখান থেকে যে কোনো মূল্যে উঠতেই চাচ্ছিলাম। পথ চিনে চিনে রেবেকার বাড়ি পৌঁছালাম দুপুরে। তিনি বাড়িতেই ছিলেন। আমাকে দেখে হাসলেন এবং চিনতে পারলেন। তার মধ্যে অসাধারণ সৌন্দর্যের পাশাপাশি একটা পবিত্রভাব দেখতে পেলাম। সংবাদ শুনে তাড়াতাড়ি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বের হলেন।
রিকশায় ওঠার পর তিনি কথা শুরু করলেন।
দুঃখিত, সেদিন আপনার প্রতি সুবিচার করা হয়নি।
আমার একটা প্রশ্ন আছে।
বলুন। এই বলুন উচ্চারণেই তীব্র একটা ব্যক্তিত্বের ছটা টের পেলাম।
নারী হিসেবে এটা কী আপনার জন্য অবমাননাকর নয়?
কোনটা অবৈধ যৌন সম্পর্ক, সৈয়দের সাথে সম্পর্ক নাকি তোমার সামনে যৌনতা?
আমি চুপ থাকলাম।
জেনে রেখ। এটা যৌনতা নয় এটা একটা যুদ্ধ।
কেমন?
সৈয়দ কি তোমাকে কিছুই বলেনি?
না। আপনার কাছে শুনতে বলেছিল।
শোনোনি কেন এতদিন?
ভয় ছিল।
পাছে জড়িয়ে যাও। সৈয়দ জড়াতে বলেছে, তাই না?
রেবেকো না লতা না বিপাশা তারপর আমাকে সৈয়দের জীবনের গল্পের একটি অংশ বলেছিলেন। তখন রেবেকার সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল একটা ইউজি পার্টি করার দৌলতে। সেভেনটিজের এক বিুব্ধ সময় ছিল সেটা। হত্যা, বদলা হত্যা, গুমখুন, জেল-জরিমানা। সৈয়দ ছিলেন পার্টির নিচের সারির সদস্য। এদের মৃত্যুর খবরই বা কে রাখে আর জেলেই বা কার কী আসে যায়? আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা অবস্থায় তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং পাক্কা দশবছর পর জেলে থেকে বের হন। আগেই বলেছি, সৈয়দ ছিলেন নিচের সারির অনুল্লেখযোগ্য একজন নেতা। ফলে তার এই জেলজীবন কারো নজরে পড়েনি। যেমন এমন আরও অনেক মৃত্যুর কথা কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না। তেমনিই ছিল তার গোপন জেলজীবন। তার উপর অবর্ণনীয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ফলে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। অধিকাংশ সময় নির্যাতন-ভীতিতে থাকতেন। তিনি যখন জেল থেকে বেরোন তখন আণ্ডারগ্রাউন্ড ওভারগ্রাউন্ড কিছুই খুঁজে পাননি। নিজের শহরে ফিরে দেখেছিলেন, তার জন্যে পর্যাপ্ত সম্পদ রেখে তার বাবা মরে গেছেন। এরপর রেবেকাকে খুঁজতে থাকেন। রেবেকাকে খুঁজে পান তার শ্বশুর বাড়িতে তার স্বামীকেও চিনতে পারেন। বলাবাহুল্য সব গল্পের মতোই তার স্বামীটিও ছিল সৈয়দের শত্র“পরে লোক। রেবেকার স্বামীর শহর থেকে রেবেকাকে তিনি নিজ শহরে নিয়ে আসেন তার আরও পাঁচ বছর পর, যখন তার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তাকে এনে রাখেন নিজের পুরানা পৈত্রিক বাড়িতে।
শোনো ও যখন যৌন সম্পর্ক করে তখন নিজের জীবনের ব্যর্থতা, আমার মৃত স্বামীর প্রতি ােভ, এই ব্যবস্থা সকল কিছুর বিরুদ্ধে তার শারীরিক প্রতিবাদ জানায়। আই এনজয় ইট।
এতকিছু জানার পর আর সৈয়দের সামনে যাওয়া যায় না। শ্রদ্ধা, অবসাদ ও বেদনায় আমি নুয়ে পড়ি। তার এই সংগ্রামমুখরতার সামনে নিজেকে অনেক ুদ্র মনে হয়। রেবেকাকে পৌঁছে দিয়ে আমি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং ওষুধ কিনতে বাজারে যাই। রেবেকা তার দায়িত্ব নিলে কিছুটা ভারহীন বোধ করি। ডাক্তার এসে দেখে যায়। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট ফুঁকতে থাকি। মানুষের জীবন, জীবন-অভিজ্ঞতা, উত্থান, পতন, গোপন বেদনা আমাকে জীবন সম্পর্কে এমন একটি আবিষ্কারের মুখোমুখি দাঁড় করায় যাকে স্বচে দেখতে গেলেও আমি ভয় পেতে থাকি। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে থাকে। দুই কি একদিন এভাবেই গেল। তৃতীয় দিনে একটু স্বাভাবিক হয়ে এলাম। সৈয়দের বাড়িতে চলাফেরায় স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠলাম আবার। এমনকি তার সামনে যেতেও। দেখলাম মৃত্যু তার দিকে ঘনিয়ে আসছে। গালের দু’পাশ বেয়ে সাদা কষ পড়ছে। পুরাতন নির্যাতনের বেদনা ফিরে আসছে তার শরীরে। তাকে আরও গরম কাপড়ে ঢেকে দেয়া হলো। আমি আর রেবেকা সারারাত শিয়রে বসে থাকলাম। তার কপালের রেখাগুলো দপদপ করছিল আর চোখ থেকে পানি ঝরে বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। বিকেলের দিকে শ্বাসকষ্ট আর কাশির গমক উঠতে শুরু করলো। ওই সন্ধ্যায় বিপাশা আমাকে সৈয়দের অদ্ভূত অনুজ্ঞার কথা শোনালেন রিডিংরুমে ডেকে নিয়ে। বললেন, সে চায় তুমি আমাকে তার সামনে চুমু খাও। হি লস্ট এভরিথিং বাট মি। সে দেখে যেতে চায় তার অনুপস্থিতিতে তুমি আমার জন্য আছ। হি হ্যাজ সিলেকটেড ইউ ফর মি।
আমি চুপ করে থাকলাম। বিপাশাও। অনেক পরে বললো, অনেস্টলি বললে সৈয়দের পরে আমি তোমাকে ভালোবাসি। ওর কাছে তোমার পুরোটা শুনেছি। অবশ্য একান্তই যদি তুমি না চাও...। যদি কোনো অনুভূতিই না জাগে তোমার। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আমি বললাম, একটু বসুন। আমি তার শরীরের দিকে তাকালাম। প্রথম দিনের ঘটনাটি নিমেষে চোখের সম্মুখ দিয়ে ভেসে গেল। কী অবাক, তার সেদিনের সেই যৌনকাতরতা এই প্রথম আমার সংবেদনে এসে ঘা মারলো। তার স্তনের কথা মনে পড়লো। অনুভব করলাম হয়তো আমি তাকে ভালো বাসতেও পারি। আমি তার চুল মুঠো করে ধরে এক পলকা একটা চুমো খেয়ে বসলাম। ওইটুকুতেই তার শারীরিক সম্মতি টের পেলাম।
রেবেকা না লতা না বিপাশা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সৈয়দের বিছানার কাছে গিয়ে হয়তো বললো, হ্যাঁ সে রাজি হয়েছে। এবার তুমি নিশ্চিন্তে মরতে পারো। তারপর আমাকে ডাকতে এলো। হাত ধরে টেনে নিয়ে সৈয়দের বিছানার কাছে দাঁড় করলো। সৈয়দ চোখ মেলে দেখলো আমরা পরস্পর চুমু খাচ্ছি। খুব গাঢ়, অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে। সে জানলো এই প্রথম। তাঁর খুশির জন্যই। কিন্তু, এ দ্বিতীয়বারের ঘটনা। শরীর এভাবেই দূরে সরে যায়। অবশ্য খুব বেশি দূর যেতে পারে কি? তার কষ্ট দেখেই কিনা জানি না আমি ও রেবেকা না বিপাশা না লতা তার আশু মৃত্যু কামনা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হলো। খুবই কষ্টকর এবং বেদনাদায়ক এক মৃত্যু। আমাদের গোপন পার্টির একজন কমরেডের প্রস্থানে আমরা শোকাহত হলাম।

Thursday, March 22, 2007

নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর (nandigram-singur) : কার জন্য কার লড়াই


মাহবুব মোর্শেদ
পরশু রাতে এনডিটিভি দেখতেছিলাম। আবারও বারখা দত্তের অনুষ্ঠান উই দি দি পিপল। আলোচ্য বিষয় : নন্দীগ্রামে পুলিশি হামলা। শিরোনাম : লালমুখো পশ্চিমবঙ্গ। লাইভ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেতা, অ্যাক্টিভিস্ট মেধা পাটকর। চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, পরিচালক ও আনন্দবাজার মিডিয়া লিমিটেড থেকে প্রকাশিত সানন্দা পত্রিকার সম্পাদক অপর্ণা সেন। ভারতীয় লোকসভায় সিপিএম-এর এমপি মোহম্মাদ সেলিম। শিল্পায়ন বিষয়ক ভূতপূর্ব সরকারি কর্মকর্তা। আর সিভিল সোসাইটি ও সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিরা। আলোচনা হচ্ছিল কলকাতার জেমস প্রিনসেপ মেমোরিয়ালে। আলোচনার শুরুতে বারখা বললেন, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সিপিএম ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া উচিত কি না? চাওয়া উচিত। একশ ভাগ উপস্থিত মানুষ হাত তুললেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই ঘটনা নিয়ে বিরোধীরা ওভার রিঅ্যাক্ট করেছে বলে মন করেন কিনা? একশ ভাগ মানুষের হাত উঠলো আবার।
নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের ঘটনাটা অনেকদিন ধরেই খেয়াল করছি।
এই ঘটনার আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার মোটামুটি কৃষকদের পরে শক্তি হিসাবেই পরিচিত ছিল। বলা হয়, বামফ্রন্ট সরকারের এতদিন টিকে থাকার অন্যতম কারণ ভূমি সংস্কার। ন্যূনতম ভূমি রাখার সিলিং নির্ধারণ কৃষি জমির বণ্টন, বর্গা ইত্যাদি নিয়ে তারা নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর এ কারণে তাদের জনপ্রিয়তা গ্রামে ছিল আকাশছোঁয়া। কলকাতা বা শহর অঞ্চলে তারা তৃণমূল বা কংগ্রেসের সঙ্গে নিয়মিত হারলেও গ্রাম হলো বামফ্রন্ট সরকারের মূল ঘাঁটি। কিন্তু জ্যোতি বসুর অবসর নেয়ার পর বুদ্ধদেব একটু অন্য চালে চলতে থাকেন। তিনি আধুনিক পশ্চিমবঙ্গ গড়ার জন্য শিল্পায়নের ভিত্তি তৈরি করার জন্য কিছু সংস্কার কর্মসূচি নেন। মালটিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর আস্থা অর্জন করতে থাকেন অতি অল্প সময়ের মধ্যে। বেশ কিছু বিনিয়োগ হয়। কিছু কারখানাও স্থাপিত হয়। কিন্তু মালটিন্যাশনালদের আব্দার মেটাতে একবার রাজি হলেই শেষ। তাদের আব্দারের শেষ নেই। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে তারা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলাপ-আলোচনা, মতামত তৈরি ছাড়াই আগাতে থাকেন। ফলে শিল্পায়ন নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো আস্থা তৈরি করতে তারা পারেনি। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষত্রে সারাবিশ্বে যে মডেলটা বিশেষভাবে অনুসরণ করা হয়, পিআরসি মডেল নামে পরিচিত। পিআরসি মানে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। চীন সিঝুয়ান প্রদেশের বিশাল এলাকাকে এসইজেড হিসাবে তৈরি করেছে। এবং পর্যায়ক্রমে একে সম্প্রসারিত করেছে। চীনের শিল্পায়নে এই এলাকাগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এই এসইজেডগুলো স্থাপনের সময় বিপুল মানুষ উচ্ছেদ ও ঘরছাড়া হয়েছেন। কিন্তু তেমন কোনো বিদ্রোহ বা বিক্ষোভের খোঁজ আমরা পাইনি। অথবা বিদ্রোহ ঘটেনি। অনেকে বলেন, চীন যেভাবে দীর্ঘ পদপে নিয়ে এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়েছে তাতে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের পর্যাপ্ত সতর্কতা ছিল। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এই পিআরসি মডেল অনুসরণ করতে গিয়ে বিশাল ঝামেলা হয়ে গেল। সোভিয়েতপন্থীদের চীনপন্থী পতন হয়তো একেই বলে!
বামফ্রন্ট সরকারের তাড়াহুড়া, আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেয়ার ওভার কনফিডেনসের পুরো সুযোগ নিয়েছেন মমত ব্যানার্জি। তিনি যখন বিগত সরকারের মন্ত্রী ছিলেন তখন ভূমি অধিগ্রহণ, এসইজেড কোনো প্রসঙ্গেই তার দ্বিমত দেখা যায়নি। কিন্তু যখন বামফ্রন্ট সরকার এদিকে ঝুঁকলো তখনই মমতা ব্যানার্জি তার বিপন্ন পলিটিকাল ক্যারিয়ার পুনরুদ্ধারের একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের জন্য আন্দোলনের ডাক দিলেন। অনশন করে একেবারে তোলপাড় ফেলে দিলেন। বামফ্রন্ট তার সঙ্গে আলাপে রাজি হলো। কিন্তু মমতা যখন জনসমর্থন পেয়ে গেছেন তখন আর ভয় কীসে। তিনি আর তাদের তোয়াক্কা করলেন না।
সিপিএম তৃণমূল তো দূরের কথা রাজ্যে তাদের মতার শরিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে বিশেষ কথাবার্তা বলেনি। আর এসইজেড হিসাবে এমন একটা এলাকাকে বেছে নিয়েছে যেখানে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল। সাংগঠনিক শক্তি কম। হয়তো নিজেদের পরীক্ষিত ঘাঁটিগুলোর কৃষকদের তারা ক্ষেপাতে চায়নি। ফলে, সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামকে বেছে নিয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের অনেক আগে থেকেই নন্দীগ্রামে পুলিশের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বিরোধীরা সেখানে গ্রামবাসিদের সহযোগিতায় শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছিল। সিপিএম কোনো দায়িত্বশীল আচরণ না করে। পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের সহযোগিতায় ওখানে তাদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চেয়েছিল। এটা করতে গিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর নির্বিচারে গুলি করেছে। অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত, নিখোঁজ হয়েছেন। নারীরা ধর্ষিত হয়েছেন। সিবিআই তদন্ত করে তাৎণিকভাবে কিছু আলামত পেয়েছে যাতে সিপিএম ক্যাডাররা গুলি চালানোর সাথে জড়িত এমন প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু কালকে সিপিএম নতুন এক ভিডিও চিত্র আদালতের উপস্থাপন করেছে। ওই ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে স্পষ্টভাবেই গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে শিশু ও নারীদের মানব ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সিপিএম নন্দীগ্রাম থেকে বেশকিছু নারীকে কলকাতায় এনেছে। বৃন্দা কারাত বলেছেন, নন্দীগ্রামে যদি পুলিশ যেতে না পারে তবে এদের নিরাপত্তা কে দেবে?
এই নারীদের কয়েকজন বলেছেন, তৃণমূল কর্মীরা তাদের স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। নির্যাতন করেছে। আগুন লাগিয়েছে। ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনাও ঘটিয়েছে।
বোঝা যায়, গরীব মানুষ, তাদের সাধের জমি নিয়ে কি নোংরা রাজনীতিই না চলছে।
নন্দীগ্রামে অধিগ্রহণ আপাতত বন্ধ। মনমোহন সিং একে দুঃখজনক বলেছেন। কিন্তু শিল্পায়ন কি বন্ধ হবে? টাটারা কি ফিরে যাবে? কৃষকের জমি হারানোর প্রক্রিয়া বন্ধ হবে?
বলা হচ্ছে এসইডেজ ও ভূমি অধিগ্রহণ নীতিকে নতুন করে বিচার করা হবে। কিন্তু তাতে করে শেষ পর্যন্ত কৃষকের রাগ কি প্রশমিত হবে?
এনডিটিভির উই দি পিপল অনুষ্ঠানে মেধা পাটকর খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যু তুলেছিলেন। ওইখানে উপস্থিত সিভিল সোসাইটির অনেকেই ছিলেন শিল্পায়নের পক্ষে, তারা হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করছেন কিন্তু চাচ্ছেন আলাপ-আলোচনা ও সঠিক নীতির ভিত্তিতে শিল্পায়ন হোক। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ যেখানেই একরের পর একর জমি নিয়ে কারখানা গড়ে তোলা হবে সেখানেই কৃষিজমি দখল করতে হবে। গ্রাম উচ্ছেদ করতে হবে। কৃষক জমি হারাবে, কাজ হারাবে, বিপন্ন হবে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তো আর কৃষকের জমি আর কারখানা একসাথে রাখা যাবে না। এটা সাংঘর্ষিক। পরস্পরবিরোধী বিষয়। ফলে, কারখানা তৈরি করতে হলে কৃষককে উচ্ছেদ হতেই হবে। কিন্তু কৃষক কেন কারখানার জন্য তার জমি ছাড়বে? রাষ্ট্রই বা কেন কৃষককে জমি ছাড়তে বাধ্য করবে? কৃষক যদি বোঝে কারখানায় তার কাজ মিলবে। এ জমি গেলেও অন্য জমিতে উৎপাদিত শস্যে তার পেট ভরবে। অথবা কারখানাটা কৃষিভিত্তিক তবে না সে কিছুটা আস্থা পাবে। কিন্তু মালটিন্যাশনালরা যে কারখানা তৈরি করতে উৎসাহী তাতে কর্মসংস্থান হবে না। উৎপাদিত পণ্যের সাথে স্থানীয় বাজারের সম্পর্ক থাকবে না। কাঁচামালও স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হবে না। জমি উচ্ছেদ করে সুগার মিল বসালে এক কথা, মোটর গাড়ি স্থাপন করলে আরেক কথা। কিন্তু আমাদের মুর্খ কর্তারা সাবাইকে মুর্খ বানানোর জন্য বলতে থাকেন, বিনিয়োগ আসছে। কোন বিনিয়োগ কিসের বিনিয়োগ কী শর্ত, পরিবেশের ওপর প্রভাব কী কিচু নিয়ে আলোচনার দরকার নাই। টাটা আসছে জমি দাও। যা চায় তাই দাও। যে শর্তে চায় সে শর্তেই দাও। কেন?
টাটা আমাদের দেশেও বিনিয়োগ করবে। ভারতের কোম্পানি না হলে এতদিনে তারা গেড়ে বসতে পারতো। পারে নি তাতে কী? পারবে। পারানো হবে। সেক্ষেত্রে নন্দীগ্রামের অভিজ্ঞতা আমাদেরও কাজে লাগতে পারে।
মেধা পাটকর বলছিলেন, বহুজাতিক তোষণের শিল্পায়ন নীতিটা আসলেই গ্রহণযোগ্য নয়।
Foto credit : www.flicr.com

Sunday, January 21, 2007

হাইপার রিয়েল সাইবার স্পেস


মাহবুব মোর্শেদ
(এই লেখাটি লিখেছিলাম ইন্টারনেট শেখার প্রথম পর্বে। ২০০৪ সালে। ডকুমেন্টেশনের খাতিরে এটি ব্লগে আপলোড করলাম। লেখাটি ২০০৪ সালের আজকের কাগজ সূবর্ণরেখা ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। নাম ছিল সাইবার স্পেসে এক চিলতে হাইপার রিয়েলিটি। নামটা ছাড়া এই লেখার কিছুই আর পরিবর্তন করিনি।)


ফ্রেন্ডফাইন্ডারের সাইন আপ বাটন কিক করতেই স্ক্রিনে ভাসতে থাকলো একগাদা অপশন। কী খুঁজছো তুমি। মেল না ফিমেল। বয়স কত থেকে কত? ভেবে দেখো, আমেরিকান সিঙ্গেলদের খুঁজছো না তো? পৃথিবীর অন্য কোথাও অন্য কোনো দেশে তুমি কাউকে চাও? শুধু বলো। তুমি লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, মনোগ্যামিক, পলিগ্যামিক যাই হও না কেন নিরাশ হবে না। শুধু বলো, কি-বোর্ডে আঙুল রেখে শর্টকাট লিখে ফেল, কী চাও। এই মুহূর্তে সারা দুনিয়ায় ৩০,০০০ মানুষ অনলাইনে ফ্রেন্ডফাইন্ডার ব্যবহার করছে। মিলেও তো যেতে পারে তোমার পছন্দের সাথে অন্য কারো পছন্দ। এমন লোভনীয় সব প্রস্তাবে চোখ বন্ধ করলাম। এই যে এক টুকরো সাইবার ক্যাফে বাণিজ্যিক ভবনের এক কোণের একটা রুম ভাড়া করে তৈরি। রুমের ভেতরে আরো ছোট ছোট খুপরি। হার্ডবোর্ড দিয়ে আলাদা করা সাতটি পিসি। তুমি একবার ওই হার্ডবোর্ড ঘেরা ছোট্ট ঘরে ঢুকলেই কিনতে পারো স্বপ্ন, বাস্তবতা, জ্ঞান, বন্ধুত্ব, যৌনতা... হোয়াট নট। চোখ খুলে স্ক্রিনে তাকালাম। মাউসে হাত রেখে স্ক্রিনটাকে নিচে টানলাম। নতুন ঘোষণা, নতুন প্রস্তাব। তুমি কি নতুন কোনো বন্ধু খুঁজছো? হারানো প্রেমিক বা প্রেমিকাকে পেতে চাও? ছোটবেলার কোনো বন্ধুকে পেতে চাও নতুন করে? বন্ধুর সাথে কতদূর এগুতে চাও তুমি? স্রেফ কথা চালাচালি, আইডিয়া বিনিময়, মনের ভাব বিনিময় নাকি ডেটিং পর্যন্ত এগুবে? শুতে চাও? মুখ ফুটে বলো একবার। না তাও করতে হবে না...শুধু টাইপ করে জানাও। কী করতে পারি আমি? মস্তিস্কের গতি দ্রুত হতে থাকলো। মাথায় একগাদা অপশনে কিক কিক করতে করতে হঠাত এক সময় ঘিঞ্জি, দূরের শৈশবে থমকে দাঁড়ালাম। বেশ, ছোটবেলার এক বন্ধুকে খুঁজে পেতে চাই আমি। কুড়ি বছরের দীর্ঘ ব্যবধানে একটি নামই শুধু মনে এলো জাহিন। লিখলাম জাহিন আলম, এজ পঁচিশ থেকে সাতাশ, জন্ম বরিশাল, এখন থাকতে পারে ইউএসএ-তে, অঙ্গরাজ্য বলতে পারছি না, শহর তাও নয়। খুঁজতে থাকলো ফ্রেন্ডফাইন্ডার। হতাশ। কাউকে পাওয়া গেল না। বেশ তুমি কি আরো তথ্য যোগ করতে চাও? জিজ্ঞেস করলো। না আমি বরং কাটছাঁট করতে চাই। লাস্টনেম কেটে দিলাম। আপাতত যে কোনো জাহিন হলেই চলবে। সার্চ রেজাল্ট এবার প্রসন্ন। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার সামনে এখন সাতজন জাহিন। বেশ তো... একে একে সবার তত্ত¡-তালাশ করা যাক। দু’জন ছবি দিয়েছে। বাকিরা বন্ধু হলে ছবি দেবে বলে প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। একজন জন্ম নিয়েছে আমেরিকায়, বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ খুব। মাত্র একজন আছে এখন অনলাইনে, জাহিন ৭৭, বেশ তো দেখাই যাক না কে সে? কিক করলাম তার নামে। তাকে ভড়কে দেবার জন্য লিখলাম, তোমাকে এভাবে এতদিন পর সাইবার স্পেসে পাবো ভাবিনি, তুমি কি আমাকে মনে করতে পারো? মেসেজ পাঠিয়ে অপোর পালা। এই ফাঁকে ইয়াহু মেসেঞ্জার মারফত রোমাঞ্চ অপশনে সিঙ্গেলদের চ্যাটরুমে লগ ইন করলাম। ভেসে এলো পৃথিবীর কয়েকশ, সিঙ্গেল, প্রেমতাড়িত, যৌনতাতাড়িত ছেলেমেয়ের মুখ। সবগুলোই হলুদ। মেসেজ বক্সে তাদের হাজারো আর্তি। নদীর স্রোতের মতো ভেসে যায়। এত কথা, এত সময়, এত আর্তি, ভালোবাসা। সারা পৃথিবীর খোপে খোপে বন্দি লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর একাকীত্বভরা এই কুহকের দুনিয়া। নামে-বেনামে তারা জানিয়ে চলেছে তাদের দীর্ঘশ্বাস, হতাশা, আশা। প্রতি সেকেন্ডে দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে সাইবার স্পেসের অতলে। কখনো মনে হয় এরা কেউ কারো কথা বুঝতে পারছে না, সবাই নিজের নিজের কথা, কাম, ভাবনাকে প্রকাশ করে চ্যাটরুম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কখনো কেউ কেউ কাউকে কাউকে সাড়া দিচ্ছে অদ্ভুত ছদ্মনামের আড়ালে সান্ধ্যভাষায়, গাণিতিক সংকেতে। একজন জিজ্ঞেস করছে, এই চ্যাটরুমে এমন কোনো মেয়ে আছ যে কালো ছেলের সাথে এখনই শুতে প্রস্তুত? ছেলে কি মেয়ে বোঝা কঠিন, এক ছদ্মনাম চার মেসেজ পর সাড়া দিলো আছি। একজন হঠাত জিজ্ঞেস করলো কেনিয়া থেকে কেউ আছেন? শত শত মেসেজ চলে যায়.... না নেই কেনিয়ার কেউ। লিস্ট থেকে একটা নাম পছন্দ করে তাকে লিখলাম, রোজলিন, তুমি যৌনতা ও কুন্ডেরা বিষয়ে কথা বলবে? মেসেজ চলে গেল।
আবার অপো। ফ্রেন্ডফাইন্ডারে কিক করলাম। জাহিন উত্তর দিয়েছে। স্যরি, আই কান্ট রিকগনাইজ য়্যু। আমি উত্তর দিলাম, চিনতে পারবে। আগে ফ্রেন্ডফাইন্ডারের চ্যাটরুমে আসো। মেসেজ সেন্ড করে ইয়াহু মেসেঞ্জারে এলাম। কোনো উত্তর নেই। তবে কি রোজলিন আমার সাথে যৌনতা ও কুন্ডেরা বিষয় আলাপে উতসাহী নয়? হ্যালো রোজলিন, তুমি কি অনলাইনে নেই? কোথাও চলে গেছ? উত্তর নেই।
ফ্রেন্ডফাইন্ডারের চ্যাটরুম। আমি আর জাহিন মুখোমুখি। হতে পারে সে আমার ছেলেবেলার বন্ধু, নাও পারে। নিজের মুখের প্রতিটি øায়ু বিপ বিপ করে অনিয়ন্ত্রিত সংকেত পাঠাচ্ছে, টের পাচ্ছি।
জাহিন তুমি কি ঠাকুরগাঁয়ে কখনো ছিলে?
নাহ্।
স্যরি, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু।
তাতে কী? তুমি খুব নস্টালজিক।
না তা নয় তবে আজ মন খারাপ খুব।
বেশ তো কথা চলুক কিছুণ।
তোমার ছোটবেলা কোথায় কেটেছে?
বরিশাল।
ইউএসএ-তে কেন গিয়েছ?
বিয়ে হয়ে গেল।
তোমার স্বামী?
আছে। পার্সোনাল ম্যাটার, আর এগিও না।
ফ্রেন্ডফাইন্ডারে কী খোঁজো?
সাম ওয়ান টু টক?
অ্যাম আই ওকে?
নো, ইউ আর আনপ্রাকটিক্যাল।
তুমি বললে পর্্যাকটিক্যাল হবো।
আমি তোমার কে?
কেউ না। সব কিছু।
ঠিক আছে। আমি ফ্রেন্ডফাইন্ডারের জাল থেকে বেরোতে চাই... তোমার পার্সোনাল ইমেল?
আমি আমার ইমেল অ্যাড্রেস লিখলাম।
ঠিক আছে। আমি এখন উঠবো। পরে আলাপ হবে।
বাই।
সি ইউ।
এ এক অভাবিত ব্যাপার। তৃপ্তিময়। এত সহজে এমন কখনো ঘটে না। ভেরি কো-ইনসিডেন্টাল। অবাক করা। ইন্টারনেটে অনেকদিন পর আজ একটা সত্যিকার ‘শুরু’ হলো। সাইন আউট করে ফ্রেন্ডফাইন্ডার থেকে বের হলাম। ইয়াহু মেসেঞ্জারে কোনো পাল্টা মেসেজ আছে কিনা দেখতে গিয়ে থমকে গেলাম। জাহিনের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি মেসেজ আসার সংকেত টের পাইনি। একজন গ্লোরিয়া আমার জন্য মেসেজ পাঠিয়েছে।
রোজনিলেন বদলে তুমি কি আমার সাথে কথা বলবে?
আজ ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন কেন, রাশিফলে কী লেখা হয়েছে? মেসেজ বক্সে দ্রুত লিখলাম
হোয়াই নট? সঙ্গে সঙ্গে সেন্ড করে আবার লিখলাম
হেয়ার আর য়্যু ফ্রম?
উত্তর এলো
কোলন, জার্মানি। য়্যু?
বাংলাদেশ। ডু য়্যু লাইক কুন্ডেরা?
ডেফিনিটলি।
গ্লোরিয়ার বাড়ি চেক রিপাবলিক। ’৯০ এর দশকে বাবা-মায়ের সাথে চলে যায় কোলন শহরে। এরপর সেখানেই বাস করছে। মিলান কুন্ডেরাকে তার খুব পছন্দ। সবচেয়ে পছন্দÑ ‘আনবিয়ারএবল লাইটনেস অব বিয়িং’। চেকোশ্লাভাকিয়ায় রাশান সেনাবাহিনী সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের উদ্দেশ্যে যে আগ্রাসন চালায় তাতে ভয়ানক বিরক্ত সে। ওই সময় এবং পরবর্তী পূর্ব-ইওরোপের বিষণœতার সবটাই যে কুন্ডেরা চিত্রায়িত করেছেন তার উপন্যাসে এই ব্যাপারটাই তাকে মুগ্ধ করে। আমি বলি, আমার পছন্দ ‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’। একজন কবি যে আসলে মাতৃগর্ভ থেকেই কবি হয়ে বেড়ে উঠছে, নানা উপলব্ধির সম্মুখীন হচ্ছে, তার ওই কাব্যিক জীবন ভ্রমণটা আমাকে প্রাণিত করে। আলাপ চলতে থাকলো আরো কিছুণ, আরো টুকিটাকি। কিন্তু, সে ইওরোপীয় আর আমি এশীয় বলেই হয়তো ব্যক্তিগত কোনো প্রসঙ্গ উঠলো না। আবার দেখা হবে বলে বিদায় নিলাম পরস্পরের কাছ থেকে।
আবার িি.ি ুধযড়ড়. পড়স। গ্র“প অপশনে কিক। সাইন ইন। অ্যাডাল্ট + বাংলাদেশ। মোট ২৭টি গ্র“প। সর্বোচ্চ গ্র“প মেম্বার ২২৫, হট-উইমেন-এ। শুধু গরম মেয়েরা নয় গরম ছেলেরাও হতে পারো এর গর্বিত সদস্য। শর্ত একটাই, সদস্য হতে হবে। সদস্য না হলে এ গ্র“প সম্বন্ধে জানতে পারবে না কিছুই। ঠিক আছে তা-ই সই। এভাবেই চলছে। দুনিয়া খুঁজে একটার পর একটা গ্র“পের সদস্য হওয়া এবং দু’দিন পর আনসাব্সক্রাইব করা। ইন্টারনেটে হাজার হাজার গ্র“প অন্তর্জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। বিচিত্র তাদের চাহিদা, বিজ্ঞাপন, ব্যবসা, কথাবার্তা, নিট্শে-পছন্দ্ গ্র“প থেকে আন্টিলাভার গ্র“প পর্যন্ত সুদীর্ঘ তাদের ফিরিস্তি। আছে ভুয়া গ্র“প, শুধু বাণিজ্যিক ফেরেব্বাজির জন্য সেক্সুয়াল ফিরিস্তি। দেখাই যাক, হট-উইমেন কী দিচ্ছে? জয়েন দ্য গ্র“প। একগাদা অপশন। নিচে এলোমেলো করে লেখা ঝঈজঅচ। টাইপ করো। হট উইমেনদের দরজা খুলে গেল তোমার জন্য। চাইলে মেসেজ আর্কাইভে গিয়ে পুরনো মেসেজ দেখো। ফটো দেখতে চলে যাও ফটোজ-এ। গ্র“পের সদস্যদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইলে বলো। এখানে, এই গ্র“পে চলছে তেলেসমাতি কারবার। মেসেজগুলোতে আছে নাখাস্তা যৌনগন্ধী কথাবার্তা। বাংলাদেশের হাইকাশ প্রোস্টিটিউটদের ফোন নাম্বার। নানা ব্যবসায়িক আমন্ত্রণ। একজনের প্রতি আরেকজনের অবিশ্বাস। গ্র“পের মেয়েরা আসলে ছদ্মনামে ছেলে কিনা এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। ফোটো অপশনে বাঙালি, ভারতীয়, ইউরোপীয়, আমেরিকান মেয়েদের একগাদা নগ্নছবি। ঘঝট এঅখ ফোল্ডারে কয়েকজন বাঙালি মেয়ে। হাস্যোজ্জ্বল, সুন্দর। দাবি করা হয় এরা স্বেচ্ছায় নিজেদের নগ্নছবি নেটে ছড়িয়েছে। কে কার ছবি কোন ওয়েবে ছড়াচ্ছে। কে কার গোপন ছবি তুলছে। কে কার প-েবিপে কী দাবি তুলছে কিছু বোঝার উপায় নেই। একজন অফার দিয়েছে হোমমেড পর্নোসিডি চাহিদা অনুসারে পাঠাতে চায়। আরেকজন লিখছে, এ মেসেজটা স্পাম ছাড়া কিছু নয়। বেশ তো, চলুক না। আজকের মতো সময় শেষ। অফলাইন জীবনে ফিরতে হবে দ্রুত। নিজের মেইল অ্যাড্রেসে আজ কী কী জমা হলো চেক করে নিয়ে বিদায়। ব্যাক। ব্যাক ব্যাক। ব্যাক। মেইল বাটনে কিক। সাইন ইন। হ্যালো মাহবুব; তোমার জন্য নতুন মেসেজ ২৮। বাল্ক মেইল ১৩। কবিসভা থেকে এসেছে ১০টি। নানাজনের নানা কথা, নানা তর্ক, নানা আবদার। বেশ। নিজের লেখা কবিতা পড়তে পাঠিয়েছে এক কবি বন্ধু। মেসেজের সঙ্গে অ্যাটাচড ওয়ার্ড ফাইল। পরশু আজিজে দেখা হবে কিনা জানতে চেয়েছে অন্য একজন। একটি আন্তর্জাতিক লটারি সংস্থা জানতে চেয়েছে আমি তাদের তোফা অফার গ্রহণ করতে প্রস্তুত কিনা। ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সম? মেইল পাঠানোর টুকটাক কাজ। ব্যাস। ইওর মেল অ্যাকাউন্ট হ্যাজ সাইনড আউট প্রোপারলি। পাক্কা দুই ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট। প্রতিদিনের ভ্রমণ। তবু এক নতুন, কষ্টকর প্রস্থান।
শুরু হলো অফলাইন জীবন। উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে প্রস্থান। বাসায় ফিরতে ফিরতে জীবনের দু’রকম নিয়ম আবিষ্কার করি আমি। অনলাইন এবং অফলাইন। যদি ভাবি, অনলাইন হলো লাইফ তো অফলাইন জীবন হলো নেয়ারার টু ডেথ। কতদিন? কতদিন হলো এইসবের শুরুর? মনে করতে পারি না। নিজের ব্যক্তিগত গুহায় ফিরতে ফিরতে রাত আর দিনগুলোকে কেবলই তারিখবিহীন মনে হতে থাকে। ওই গুহায় ফিরলে শুরু হয় সেলফোনহীন এক রাত। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে হাউ ক্যান আই কনটাক্ট ইউ অ্যাট নাইট? কোনো বিকল্প না রেখে আমি বলি, য়্যু মে কাম ফিজিক্যালি। আমার রাতের জীবনকে বন্ধুদের কাছে প্রাগৈতিহাসিক মনে হয়। তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই তো বছরখানেক আগেও আমি জানতামই না ইন্টারনেট কী? খবর শুনতাম ইন্টারনেটে চীন ও আমেরিকার মধ্যে শুরু হয়েছে রহঃবৎহবপরহব ধিৎ। মনে হতো, এ এক ভয়াবহ ব্যাপার এ দিয়ে শুধু যুদ্ধই করা সম্ভব। শুনতাম চীনেম্যানরা ইয়াঙ্কিদের নেট জ্যাম করে দিয়েছে আর ইয়াঙ্কিরা চীনেম্যানদের। ব্যাস, অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে দু’জাতি। অফিস-আদালত, ব্যবসাপত্র সব লাটে উঠেছে। এরপর শোনা গেল, সমঝোতা হয়েছে। মার্কিন স্পাইবিমান ছেড়ে দিয়েছে চীনারা। হাফ ছেড়ে বাঁচলো ইন্টারনেটের অধিবাসীরা। আরও শুনতাম যে ইন্টারনেট হলো জালিয়াতদের আখড়া। সেখানে দিকে দিকে ওঁৎ পেতে আছে বিচ্ছু আর বাচ্চা পোলাপান। এরা হলো, চোরের ওপর বাটপার। আজ এরা স্যুইস ব্যাংক থেকে কোটি ডলার সরাচ্ছে তো কাল নাসার গোপন কম্পিউটারে ঢুকছে। আজ বিল গেটসের অ্যাকাউন্ট থেকে ভায়েগ্রার মূল্য পরিশোধ করছে তো কাল পেন্টাগনের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করে দিচ্ছে। অনলাইন ব্যাপারটাই আমাকে অস্থির করে তুলতো। কিন্তু আমিও একদিন এক বন্ধুর সহায়তায় চলে গেলাম অনলাইনের খàরে। বন্ধু বললো, তুমি যদি ভাবো এটা ডাকবিভাগ তো ইন্টারনেট হলো ডাকবিভাগ, লাইব্রেরি, বন্ধু, সংবাদপত্র, খেলার মাঠ একে তুমি যা ভাববে এ তা-ই। লাইব্রেরি ঘাঁটতে ঘাঁটতে মেইলে, মেইলে যোগাযোগ করতে করতে চ্যাটিং... তারপর একের পর এক খেই হারানো কাজ, আকাজ। শেষ নেই। নেটে না বসলে আমি ইনড্রেক্স, বন্ধুদের ঠিকানা, ফোন নাম্বার কিছুই পাই না। জানতে পারি না কানাডায় বসে লেখক বন্ধুরা কী লিখছে, ইংল্যান্ডের বন্ধুরা কী নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি রংপুরের কোনো বন্ধুর খোঁজেও মেইলের পর মেইল করা ছাড়া আর কোনো উপায় মনে পড়ে না। ইমেল ছাড়া যেন তথ্যান্ধ, স্মৃতিবধির, যোগাযোগরহিত একেকটি গুহাবাসী প্রাণী আমরা। আমার বন্ধু কাজলকে ভাবলে অবশ্য অন্যরকম মনে হয়। ও নেটে তেমন ইজি ও রেগুলার নয়। নেট নাকি ওকে স্যুট করে না। একটা ছোট্ট সেলফোনেই ওর দুনিয়া। রাত বারোটা বাজতেই ওর ইন্দ্রিয়গুলো সতর্ক হয়ে বারবার সেলফোনের দিকে তাক হতে থাকে। একটা রিং-টোন বাজতেই ও লাফিয়ে ওঠে। ‘ইয়েস’ বাটন টিপে হ্যালো বলে ওঠে। ওর আছে মিষ্টি ‘ইজি টক টাইম’। ওইটুকুতেই সে খুশি। মিনিটগুনে একটু আলাপ, একটু প্রেম, একটু ভালোবাসা, একটু মন খারাপ, একটু সম্ভাবনা, একটু বিপদ ব্যাস। ঘুমিয়ে পড়ো সকালে অফিস, বিকেলে আড্ডা। সারাণ ওর সঙ্গে আছে কেজো, ছোট্ট, মিষ্টি সেলফোন। দ্রুত কাজের কথা, টাকা গুনে প্রেমÑ হয়তো দেখেছো দু’চার ফোটা জলে/চড়–ই পাখির চার সেকেন্ডের øান/আমিও এখন ওই পাখিটির দলে/শুনিয়ে দিলাম চার লাইনের গান।’
শ্যামল যেদিন প্রথম আমাকে শেখালো সার্চ ইঞ্জিন কী, আর কিভাবেই বা প্রতিটা টপিক নিয়ে ঋদ্ধ হয়ে আছে লাখ লাখ ওয়েবসাইট সেদিন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। এ যেন ‘গো-খুরের গর্তে জমা জলে, নত্রের রাখঢাক খেলা চলে।’ ডায়ালজিক পলিফনি, ফার্টিলিটি কাল্ট, গেরিলা ওয়ারফেয়ার কী নেই এতে? সেই সময়টাতে তোলপাড় চলছে বাংলাদেশে। পিন্টু সুমনের সিডি বেরিয়েছে। ভদ্রঘরের মেয়েরা না জেনে শুয়েছিল ওই বদমাশের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে যৌনকর্ম করে সেই সিডি বাজারে ছেড়েছিল সে। ইন্টারনেটেও দিয়েছিল কেউ। একের পর এক এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছিলো তখন ক্যামেরা লুকিয়ে রাখা ছবি তোলা, সিডি করে মার্কেটে ছাড়া, এইসব। একদিন শোনা গেল, সাইবার ক্যাফের ছাদে গোপন ক্যামেরা লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। তখন অনেক জুটি সাইবার ক্যাফের আলো-অাঁধারি, এক চিলতে ঘের দেওয়া জায়গার প্রাইভেসিকে নিজেদের ডেটিংপ্লেস হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। মতলববাজরা সেখানেও বসিয়ে দিলো ক্যামেরা। এক সময় ক্যামেরা চুরি করে ছবি তুলতো। আজ শুরু করেছে ডাকাতি করে ছবি তোলা। ওই ক্যামেরা এখন পুরো দেশে ছড়িয়ে গেছে। ঘরে ঘরে গোপন ক্যামেরা। ঘরে ঘরে ব্লাকমেইলিং। সিডি ব্যবসা। শোনা যায়, হোমমেড পর্নো সিডি’র কাছে হার মানছে বিদেশি পর্নো। আর ওই ক্যামেরার মতা এখন এমনই আকাশচুম্বি যে, ছোট্ট, শান্ত ওয়েব ক্যামেরা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলের বাথরুম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
এসব ভাবলে নৈতিকতার প্রশ্ন তাড়া করে। আমরা কি তবে আনএডিটেড, আনসেনসরড, র এবং প্রিমিটিড কোনো ভাব প্রকাশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি? ক্রমশ আমরা অনেক কিছুর সাথে যুক্ত হচ্ছি। এগিয়ে চলেছি। কোথায় এগিয়ে চলেছিÑ তা জানি না। গতকাল যে খুপরিতে বসে ব্রাউজ করছিলাম, তার পাশের খুপরিতে একটা স্কুল গোয়িং বয় বসেছিল। গোঁফ ওঠেনি। স্কুলব্যাগ নিয়ে খুপরিতে ঢুকেছিল। তার খুপরিতে কিছুণ পর একটা উশখুশ টের পাচ্ছিলাম। আমি জানি না ওই ছেলেটি মাস্টারবেট করছিল কিনা। আসলেই জানি না। আই ক্যান গেজ। কিন্তু নিশ্চিত কিছুই জানি না।
জাহিনের সাথে সময় ঠিক করা ছিল। ওকে নিয়ে রাতে একটু ভেবেছি। কী বলবো ঠিক করে রেখেছি। আর ভেবেছিÑ ওর সঙ্গে আলাপে কনসেনট্রেট করবো। এদিক সেদিক ফালাফালি করবো না। মেসেঞ্জারে লগ ইন করতেই অবাক। জাহিন উপস্থিত। অনলাইন।
‘তুমি দশ মিনিট লেট।’
‘রাস্তায় জ্যাম ছিল।’ মিথ্যা দিয়ে শুরু করলাম।
‘য়্যু স্যুড পে ফর ইট।’
‘স্যুড আই?’
‘ইয়েস’
‘কাল রাতে আমাকে নিয়ে ভেবেছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী ভেবেছ?’
‘য়্যু ফার্স্ট।’
‘আমি ভেবেছি নিজেকে নিয়েÑ তুমি যখন আমার সবটা শুনবে তখন কি তোমার আমাকে ভালো লাগবে?’
‘কেন?’
‘কারণ আমি তো প্রতিবন্ধী, কানে শুনি না।’ আবারও একটা মিথ্যা। আমি জানি না কেন জাহিনের সঙ্গে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে মিথ্যা একটা পরিস্থিতি তৈরি করে ওর প্রতিক্রিয়া যাচাই করতে চাইলাম। জাহিন একটু চুপ থেকে লিখলোÑ
‘অ্যাঅ্যাম স্যরি। কিন্তু তাতে কী। আমাদের বন্ধুত্বের জন্য এটা সমস্যা নয়।’
‘বেশ তো। তুমি কী ভাবলে বলো।’
‘আমার প্রথম প্রেম নিয়ে। তোমার মেইল পেয়ে হঠাৎ অবাক হয়েছিলাম। কোনো প্রেমিক তার হারানো প্রেমিকাকে খুঁজছে নেটে এটা আমাকে বিস্মিত করেছে।’
‘আর আমাকে বন্ধু ভাবলে কেন?’
‘কারণ তুমি নিজের নাম ব্যবহার করেছ। কিছু লুকাওনি।’
‘তোমার কি মনে হচ্ছে না আমি তোমার সাথে মিথ্যা বলছি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘কারণ, আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে চাই।’
আবারও বিশ্বাস, নৈতিকতা ও সততার প্রশ্ন। এই ফ্যান্টাসির দুনিয়ায় কে কাকে বিশ্বাস করে? কে কাকে সত্য বলে? সাইবার স্পেসে হাইপাররিয়েল অভিযাত্রায় বিশ্বাস ধারণাটাই খুব অপ্রাসঙ্গিক, অকার্যকর। জাহিন আমাকে দেখবে না কোনোদিন, আমিও না। আমি যা বলবো আমি তা-ই। জাহিন যা বলবে জাহিন তা-ই। তবু কথা এগিয়ে চলেÑ একদিন, দু’দিন, তিন-দিন প্রতিদিন। জাহিনও কি মিথ্যা বলছে? আমি জানি না। আমার প থেকে আমি বুনে চলেছি মিথ্যা কথার এক সুদীর্ঘ পাহাড়। আমি বধিরÑ প্রতিবন্ধী। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কারও সাথে কথা বলতেই আমি স্বস্তি বোধ করি না। সবার বাঁকা চোখ আমাকে তাড়া করে। তাই ইন্টারনেটের দৃশ্যময় হাইপার-রিয়েলিটিই আমার আশ্রয়। আমি ভালোবাসি দৃশ্যময়তার যাদু। অনলাইন জীবনই আমার স্বস্তি, শান্তি আর পরিতৃপ্তির জীবন। যা কিছু শব্দময় তা আমার অনধিগম্য। শুনেছি যে শব্দদূষণে পৃথিবী বিপর্যস্তÑ আমি কিছুই বুঝতে পারি না এর। জন্মবধির বলে কোনো শব্দই আমি শুনতে পারি না। আর কে না জানে, যে জন্মবধির সে তো বাকরহিত। আমি কথাও বলতে পারি না। আমি পড়তে শিখেছি, লিখতে শিখেছি বধির, বাকরহিত, জন্মান্ধদের স্কুলে। আমার এক জন্মান্ধ বন্ধু ছিল। স্কুল শেষ হলে সে কোথায় চলে গেছে আমি জানি না। আর জাহিন? জাহিন থাকতো আমাদের ঠাকুরগাঁয়ের বাসার সামনের বিল্ডিং-এ। আমি তাকে বন্ধু ভাবতাম। তার দিকে সারাণ তাকিয়ে থাকতাম। কিছুই বলতাম না, তার কাছ থেকেও শুনতাম না কিছুই। শুধু একটাই স্মৃতি তার সঙ্গে আমার। একদিন পথে একা পেয়ে সে আমাকে একটা কদম ফুল উপহার দিয়েছিল। ওইটুকুই। জাহিনকে নিয়ে আর কিছুই মনে পড়ে না। জাহিন ৭৭ এইসব শুনে ভীষণ অবাক হয়। তুমি বধির ও বাকরহিত কিন্তু তুমি আমার সামনে এমন এক জগৎ খুলে দিয়েছো যে, আমি তার সাাত পাইনি কোনোদিন। তোমার সঙ্গে পরিচয়ের আগে ভাবিনি শব্দহীন ও বক্তব্যহীন এক জীবন আছে। তোমার ওই দৃশ্যময় জগতকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আঅ্যাম ইন লাভ।
এক কাজিনের সঙ্গে প্রেম ছিল জাহিনের। ও তখন দেশে। কাজিন বেকার ছিল আর জাহিন ছিল অপূর্ব সুন্দর। কী থেকে কী হয়ে গেল। বাবা-মা আমেরিকা প্রবাসী এক ছেলের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলো। রূপ নিয়ে সে চলে গেল দূরেÑ আমেরিকায়। কিছু ভাল লাগে না তার। স্বামী ব্যস্ত। কাজ, কাজ আর কাজ। ও কারো সাথে মিশতে পারে না। কাজিনের সাথে যোগাযোগের উপায় নেই। বহুদিনের ব্যবধানে সে এখন কোথায় জানেও না জাহিন।
সাইবার স্পেসের বন্ধুত্ব কতদূর গড়ায়? বিশ্বজিৎ আর অরুণিমা আমাদের খানিকটা দূরের বন্ধু। ওদের দু’জনের পরিচয় নেটে অ্যাডাল্ট চ্যাটরুমে। ওখানকার পরিচয় বিছানা পর্যন্ত গড়িয়েÑ এখন চলছে দাম্পত্যপর্ব। ওদের সঙ্গে দেখা হলে খুব ভালো লাগে। ওরা ওদের বেডরুমের সামনে লিখে রেখেছে ‘সাইবার ক্যাফে’। ওদের নিয়ে মজার একটা ক্যাপশন মাথায় আসে আমার ‘ফ্রম চ্যাটরুম টু বেডরুম’। বিশ্ব’র সাথে দেখা হলে রক্তিমের প্রসঙ্গ ওঠে। রক্তিম বোধহয় বিশ্ব’র ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে নেটে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিল। তার নেট-বন্ধুত্বের পরিণতি জানতে পেরে আমরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। যে মেয়ের সঙ্গে গত ছ’মাস নেটে প্রেম চলছে ওর অবশেষে জানা গেল, সে আসলে একটা ছেলে। প্রতারিত রক্তিমকে সান্ত্বনা জানানোর ভাষাও আমাদের জানা নেই। রক্তিম নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে আর কোনোদিন নেটে বসবে না। সাইবার ক্যাফে দেখলে ওর মধ্যে ব্যর্থপ্রেমের গ্লানি ফিরে আসে। রক্তিমের দিক থেকে ইন্টারনেটকে ভিলেন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। উদভ্রান্ত প্রেম আর যৌনতা রক্তিমকে অন্ধ করে দিয়েছিল। নাকি এ অন্ধত্ব নিবারণেরও কোনো উপায় নেই?
একবার টাইম ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম, ইওরোপ-আমেরিকার বাবা-মায়েরা শঙ্কিত তাদের টিনেজার ছেলেমেয়েদের নিয়ে। কেননা সারাবিশ্বে টিনেজারদের জন্য, টিনেজারদের নিয়ে রয়েছে অসংখ্য পর্নোসাইট। এই সাইটগুলো কৌশলে টিনেজারদের প্রলুব্ধ করে, এক্সপ্লয়েট করে তাদের ছবি, ভিডিও ইত্যাদি দিয়ে গড়ে তুলেছে অসংখ্য ওয়েবসাইট। ওই সময় বাবা-মা-রা সেন্সরশিপের প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করছিলেন তীব্রভাবে। ইউরোপ-আমেরিকার চার্চগুলোও সোচ্চার হয়েছিল এ নিয়ে। তারপর? তারপর আর এ নিয়ে জানা যায়নি কিছুই। ইন্টারনেটেই ইন্টারনেটের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হচ্ছে জনমত। আবার ওই ইন্টারনেটেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে যৌনবাণিজ্য। ইন্টারনেটের অন্তর্জাল ব্যবহার করে গড়ে উঠছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। সারাবিশ্বের প্রতিবাদী মানুষ নেটে-নেটে যোগাযোগ গড়ে তুলে একত্রিত হয়েছিল সিয়াটলে। তখন একবারের জন্য চমকে উঠেছিল পৃথিবী। সেও তো এখন ইতিহাস। তারপর অসংখ্য ঘটনা ঘটে গেল কানকুন থেকে মুম্বাই পর্যন্ত। পরিবেশবাদীরা একত্রিত হচ্ছে, মাওবাদী, মার্ক্সবাদী, লিবারেল ডেমোক্রেট, সোশাল ডেমোক্রেটরা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করছে। ইরাক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শোর উঠেছে, উঠছে। আমাদের এখানেও ছিটো-ফোটা চেষ্টা চলছে না, তা নয়। তবে তা যেন নিজেরই দ্বিধায় দোদুল্যমান।
এখানকার এগিয়ে থাকা মানুষগুলোর গতির উল্টো দিকে সরকার পিছিয়ে যায় ক্রমাগত। সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হবার প্রস্তাব নানান ধানাই-পানাই করে বাতিল করে দেয়। ধূয়া তোলে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্যের নিরাপত্তার, সার্বভৌমত্ব বিপন্নকারী ষড়যন্ত্রের। যেখানে সহস্র মেকি নত্রের (স্যাটেলাইট) সাহায্যে তোলা সম্ভব দুনিয়ার যেকোনো জায়গার পুক্সানুপুক্স চিত্র, চাই কি মাটির তলায় খোঁজা যায় ওসামার মতো ব্যক্তিকে, চাইলে পদাতিক সৈন্য না পাঠিয়েও ধস্ত করা যায় পুরো বাগদাদ। সে দুনিয়ায় কিসের নিরাপত্তা, কিসের সার্বভৌমত্ব? মাথামোটা নীতিনির্ধারকদের চিকন চিকন সিদ্ধান্তে শব্দ করে ক্রন্দন করা ছাড়া উপায় থাকে না। তথ্য তো এখন পণ্যই। ডিস্কেট, সিডি, সিনেমা, সংবাদ, নাটক, সাহিত্য সবই তথ্য। একটা ডরহফড়ংি ৯৮ এর সিডিও তথ্য। অথচ আমরা এই পণ্য উৎপাদনে পিছিয়ে গেলাম চল্লিশ বছর। ভারতের বিজ্ঞানীরা যেখানে সিলিকন ভ্যালিতে দাপুটে ভূমিকায় অবতীর্ণ, এন চন্দ্রবাবু নাইডু’র সাথে দেখা করে যাচ্ছেন বিল গেটস, অন্ধ্রের গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে ইন্টারনেট তখন আমরা কম্পিউটারকে স্রেফ টাইপরাইটার হিসাবে ব্যবহার করে চলেছি। আর গল্প শুনছি, হায়দরাবাদ নামে এক শহর ছিল... ইত্যাদি।
অবশ্য উল্টোপিঠের গল্পও আছে। যে অন্ধ্রের গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিল ইন্টারনেট সেখানেই নাকি কাজ না পেয়ে শতশত কৃষক আত্মহত্যা করেছে। ফলে প্রযুক্তির উৎকর্ষ ভোটের রাজনীতিকে পরাভূত করতে পারেনি, জয়লাভ করেছিল ুধা নিবৃত্তির আকাক্সা। ফলে পতন হয়েছে নাইডু সরকারের। কিন্তু, এই কৃষক-হত্যা আর ুধার জন্য কি প্রযুক্তি দায়ী? নাকি ুধা আর প্রযুক্তিকে মুখোমুখি দাঁড় করাবার রাজনীতি দায়ী? আমাদের এখানে তো প্রযুক্তির বিকাশ, ুধার নিবারণ কোনোটাই ঘটছে না। আমরা কি তবে তথ্যের ভোক্তাই থেকে যাবো? একদল ভোগ করতে থাকবে তথ্যের তেলতেলে মাখন আর অন্যদলের হাড়ের মজ্জা পর্যন্ত শুকিয়ে যেতে থাকবে? নতুন পৃথিবীতে কোনো অবদান, কোনো কারবারই কি থাকবে না আমাদের?
একদিন সোসাইটি অ্যান্ড কালচার চ্যাটরুমে সাইন ইন করে চুপচাপ খেয়াল করছিলাম ওদের আলাপ-আলোচনা। ওই সময় জাতগর্বী কয়েকজন ইওরোপীয় আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশে তাদের জাতির অবদান নিয়ে আলোচনা করছিল। একজন জ্যু, নাম সম্ভবত মিখাইলÑ দাবি করে বসলো, মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলো ইহুদীদের। তখন আমি খুব কষ্ট পেতে থাকলাম। ভাবলাম এমে সেজায়ারের সেই লাইনগুলো ওদের উদ্দেশ্যে লিখি.... ‘যারা উদ্ভাবন করেনি কোনো বারুদ কোনো দিগ্দর্শিকা/যারা পোষ মানায়নি বাষ্প কিংবা বিদ্যুৎ/যারা সন্ধান করেনি সমুদ্রে বা আকাশে/কিন্তু যারা অন্তস্থলে অনুভব করেছিল বেদনার দেশ...’। তখন একজন ব্রিটন দাবি তুললো তারাই সেরা। জার্মান কেউ দাবি তোলার আগে সে দিতে থাকলো ব্রিটনদের আবিষ্কারের দীর্ঘ ফিরিস্তি। শেষে লিখলো, এমনকি যে ইন্টারনেটে আমরা কথা চালাচালি করছি তার শুরুটাও মার্কনির হাতে। এখানে এসে আমি থমকে গেলাম। লিখলাম, ক্রিস, ডু য়্যু নো জগদীশ চন্দ্র বসু? হি ওয়াজ দ্য ফার্স্টম্যান টু ইনভেন্ট রেডিও। ক্রিস একটু থমকালো। কিন্তু, পরণেই গাঁইগুই করা শুরু করলো। অনলাইনে কয়েকজন ইন্ডিয়ান ছিল, তারা আমাকে সমর্থন করলো। ক্রিস তখন কোণঠাসা। এরপর একজন ফ্রেঞ্চ যখন তার জাতির গৌরব বর্ণনা করতে শুরু করলো তখন আমি চ্যাটরুম থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। ফলে, আমাদের শুরুটা তো উজ্জ্বলই ছিল। কিন্তু, কী এক ঐতিহাসিক ভ্রান্তি, বিপর্যয় আর অকর্মণ্যতা আমাদের পেয়ে বসলো যে এক অবদানহীন সময়ে ও জগতে কপর্দকশূন্য ভিুকের মতো এসে দাঁড়ালাম?
ইনফরমেশন সুপারহাইওয়ে ধরে এগিয়ে চলেছেÑ প্রতিবাদী মিছিল, নগ্ন নারীদেহের প্রদর্শনী, হলিউডের সিনেমার নায়ক, ব্যস্ত সেলিব্রেটি লেখক, মিথ্যা-কথার ফুলঝুরি, সংবাদপত্র, কলাম, নতুন নতুন পরিভাষা, নতুন প্রকাশভঙ্গি। দুধ বেচে কেউ মদ খাচ্ছে। মদ বেচে কেউ খাচ্ছে দুধ। গেমিং করতে গিয়ে কেউ পরীায় ফেল মারছে। আবার ইন্টারনেটের দৌলতে কেউ পড়তে যাচ্ছেÑ হার্ভাড, অক্সফোর্ডে। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে রোগ সারাচ্ছে কেউ। কেউ হয়ে পড়ছে জরাগ্রস্ত। বিদেশ এখন অনেক নিকটে। অনলাইন জীবনে কিছুই অগম্য নয়। সবই কাছের। মার্শাল ম্যাকলুহানও এতটা ভাবতে পারেননি। এই নতুন মনস্তত্ত¡ নিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন তত্ত¡। নতুন সংস্কৃতির নতুন বিচার-বিশ্লেষণ। নতুন সমাজের নতুন সমাজতত্ত¡। অনলাইন জীবন রাষ্ট্রহীন, সমাজ-বঞ্চিত। অফলাইন জীবনে রাষ্ট্র এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াচ্ছে আমাদের। অনলাইনে যে কেউ মুহূর্তেই হতে পারে রাষ্ট্রদ্রোহী। রাষ্ট্র তাই সেখানেও বসাতে চাইছে পুলিশ। কিন্তু কতটা পুলিশ বসালে অনলাইনে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কায়েম হয়? অনলাইনে পুলিশ বসালেÑ অনলাইন দুর্নীতিও হয়তো বেঁধে ফেলবে আমাদের। রাষ্ট্রহীন দুনিয়ার নাম ইন্টারনেট। রাষ্ট্র তো ভীত হতেই পারে। তবুও একটি নাম আমাদের বেদনাবিদ্ধ করেই চলেছে, সে নাম পার্থ সাহা। সারাবিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বোমা ফুটছে বাংলাদেশেও। নাশকতা, গণহত্যা সবকিছুর আন্তর্জাতিকায়ন ঘটছে। এখন শুরু হচ্ছে মেইলে হুমকি দেয়া। নামে-বেনামে নাশকতার দায়িত্ব স্বীকার করা। তবু পার্থ সাহার অপাপবিদ্ধ মুখ আমাদের বেদনাবিদ্ধ করে চলে।
কাল মেইলে জাহিনের চিঠি এসেছে। এতদিন শ্রবণ ও বাকশক্তিসম্পন্ন লোকদের সাথে কথা বলতে বলতে আর শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে উঠেছি। তুমি আমাকে তোমার শ্রবণ ও বাকহীন জগতের ভাষা শেখাও। আমি দৃশ্যময় জগতের ভাষাই শুধু জানতে চাই। তুমি সংকেত পাঠাও। তুমি হয়তো জানো না আমার বেদনায়ময় একঘেঁয়ে প্রবাসে স্বামী ও এক চিলতে স্বচ্ছল সংসারের নৈমিত্তিকতায় তুমি এক বিস্ময় হয়ে উপস্থিত হয়েছ। আমি তোমাকে জানতে চাই, তোমার চোখ দিয়ে চিনতে চাই নিজেকেÑ পৃথিবীকে। জানি, তোমার জন্য এটি নতুন কোনো সান্ত্বনাই বয়ে আনবে না। কেননা আমি তোমাকে ছোটবেলায় কোনো কদমও দেইনি কখনো। তোমাকে সান্ত্বনাই বা দেব কী? তুমিই বরং আমাকে সান্ত্বনা দিও। প্রতিদিন মেইল করো আর চ্যাটরুমে এসো। আমার জন্য। মিথ্যা করে হলেও আমাকে তোমার শৈশবের হারানো বন্ধু ভেবে। আমি খুব অপরাধীর মতো লিখলাম হ্যাঁ। ইয়েস।
আত্মীয়তাহীন পৃথিবীতে আত্মীয়তা, হৃদয়বত্তির উৎসার আর ভালোবাসা-যৌনতার প্রকাশ আমাকে ভাবিয়ে তোলে। রিয়েল, অরিজিনাল, পার্মানেন্ট, ইত্যাকার শব্দের পাশে আমি ননরিয়েল, ভার্চ্যুয়াল, ইরেজিং ইত্যাদি শব্দ পরপর তৈরি করি। বস্তু জগতের পাশে জমা হয় একটা অনুজগৎ। মহাপৃথিবীর স্পেসের পাশে গিগা গিগা স্পেস। প্রিয় বান্ধবীর পাশে দেখতে পাই ভার্চ্যুয়াল গার্লফ্রেন্ডেকে। নব-আবিষ্কৃত ‘গার্লফ্রেন্ডে’র দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, বেদনা-মানুষের সকল অনুভূতিই হয়তো একদিন কম্পিউটার প্রোগ্রামে সাড়া দেবে! বিষণœতার মুহূর্তে কাঁধে এসে হাত রাখবে অলীক গার্লফ্রেন্ড। যৌনকর্মের বদলে øায়ুতন্ত্র পেয়ে গেছে যান্ত্রিক কোনো সঙ্গ বা অনুষঙ্গ। কিন্তু এসবের শেষ কোথায়? আজ হয়তো জাহিন, কিন্তু কালই কি আমি ভুলে যাব না তাকে গত পরশুর আসফিয়ার মতো। সব কিছু ইরেজিং। বছরের পর বছর যেসব চিঠি আমরা চন্দন কাঠের ছোট্ট বাক্সে জমা করি; দুর্বল, ভেজা ভাঁজ খুলে সাবধানে পাঠ করি। সেসব ইরেজিং ইমেলের চাপে ফুরিয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। কবে আপনি শেষ চিঠি পেয়েছেন? কবে আমাদের ঠিকানায় চিঠির বদলে মেইল আসতে শুরু করেছে? মেইল কি দীর্ঘস্থায়ী ? মেইল কি নিমেষে শত শত মেইলের আড়ালে চাপা পড়ে যায় না। মেইল কি ডিলিট হয়ে যায় না মাউসে দু’টো আঙুল ছোঁয়ালেই? তবু জাহিনের সাথে চ্যাট, জাহিনের মেইল সব আমি জমা করে রাখি। ইন্টারনেটেই আমার চন্দন কাঠের বাক্স, সেই আমাদের পুরনো, ছেঁড়া ছেঁড়া, ভেজা চিঠি।
আজ হয়তো আমরা বাংলাদেশে বসে টের পাচ্ছি না। কিন্তু এখানকার পুরনো, সনাতন সমাজের মধ্যে থেকেও আমাদের নতুন একটা সমাজ গড়ে উঠছেÑ সেটা হয়তো ইনভিজিবল, হয়তো আকস্মিক বা ভার্চ্যুয়াল কিন্তু সেটাও সমাজ। নতুন একটা আইডিয়া।