Thursday, March 22, 2007

নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর (nandigram-singur) : কার জন্য কার লড়াই


মাহবুব মোর্শেদ
পরশু রাতে এনডিটিভি দেখতেছিলাম। আবারও বারখা দত্তের অনুষ্ঠান উই দি দি পিপল। আলোচ্য বিষয় : নন্দীগ্রামে পুলিশি হামলা। শিরোনাম : লালমুখো পশ্চিমবঙ্গ। লাইভ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেতা, অ্যাক্টিভিস্ট মেধা পাটকর। চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, পরিচালক ও আনন্দবাজার মিডিয়া লিমিটেড থেকে প্রকাশিত সানন্দা পত্রিকার সম্পাদক অপর্ণা সেন। ভারতীয় লোকসভায় সিপিএম-এর এমপি মোহম্মাদ সেলিম। শিল্পায়ন বিষয়ক ভূতপূর্ব সরকারি কর্মকর্তা। আর সিভিল সোসাইটি ও সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিরা। আলোচনা হচ্ছিল কলকাতার জেমস প্রিনসেপ মেমোরিয়ালে। আলোচনার শুরুতে বারখা বললেন, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সিপিএম ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া উচিত কি না? চাওয়া উচিত। একশ ভাগ উপস্থিত মানুষ হাত তুললেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই ঘটনা নিয়ে বিরোধীরা ওভার রিঅ্যাক্ট করেছে বলে মন করেন কিনা? একশ ভাগ মানুষের হাত উঠলো আবার।
নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের ঘটনাটা অনেকদিন ধরেই খেয়াল করছি।
এই ঘটনার আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার মোটামুটি কৃষকদের পরে শক্তি হিসাবেই পরিচিত ছিল। বলা হয়, বামফ্রন্ট সরকারের এতদিন টিকে থাকার অন্যতম কারণ ভূমি সংস্কার। ন্যূনতম ভূমি রাখার সিলিং নির্ধারণ কৃষি জমির বণ্টন, বর্গা ইত্যাদি নিয়ে তারা নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর এ কারণে তাদের জনপ্রিয়তা গ্রামে ছিল আকাশছোঁয়া। কলকাতা বা শহর অঞ্চলে তারা তৃণমূল বা কংগ্রেসের সঙ্গে নিয়মিত হারলেও গ্রাম হলো বামফ্রন্ট সরকারের মূল ঘাঁটি। কিন্তু জ্যোতি বসুর অবসর নেয়ার পর বুদ্ধদেব একটু অন্য চালে চলতে থাকেন। তিনি আধুনিক পশ্চিমবঙ্গ গড়ার জন্য শিল্পায়নের ভিত্তি তৈরি করার জন্য কিছু সংস্কার কর্মসূচি নেন। মালটিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর আস্থা অর্জন করতে থাকেন অতি অল্প সময়ের মধ্যে। বেশ কিছু বিনিয়োগ হয়। কিছু কারখানাও স্থাপিত হয়। কিন্তু মালটিন্যাশনালদের আব্দার মেটাতে একবার রাজি হলেই শেষ। তাদের আব্দারের শেষ নেই। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে তারা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলাপ-আলোচনা, মতামত তৈরি ছাড়াই আগাতে থাকেন। ফলে শিল্পায়ন নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো আস্থা তৈরি করতে তারা পারেনি। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষত্রে সারাবিশ্বে যে মডেলটা বিশেষভাবে অনুসরণ করা হয়, পিআরসি মডেল নামে পরিচিত। পিআরসি মানে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। চীন সিঝুয়ান প্রদেশের বিশাল এলাকাকে এসইজেড হিসাবে তৈরি করেছে। এবং পর্যায়ক্রমে একে সম্প্রসারিত করেছে। চীনের শিল্পায়নে এই এলাকাগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এই এসইজেডগুলো স্থাপনের সময় বিপুল মানুষ উচ্ছেদ ও ঘরছাড়া হয়েছেন। কিন্তু তেমন কোনো বিদ্রোহ বা বিক্ষোভের খোঁজ আমরা পাইনি। অথবা বিদ্রোহ ঘটেনি। অনেকে বলেন, চীন যেভাবে দীর্ঘ পদপে নিয়ে এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়েছে তাতে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের পর্যাপ্ত সতর্কতা ছিল। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এই পিআরসি মডেল অনুসরণ করতে গিয়ে বিশাল ঝামেলা হয়ে গেল। সোভিয়েতপন্থীদের চীনপন্থী পতন হয়তো একেই বলে!
বামফ্রন্ট সরকারের তাড়াহুড়া, আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেয়ার ওভার কনফিডেনসের পুরো সুযোগ নিয়েছেন মমত ব্যানার্জি। তিনি যখন বিগত সরকারের মন্ত্রী ছিলেন তখন ভূমি অধিগ্রহণ, এসইজেড কোনো প্রসঙ্গেই তার দ্বিমত দেখা যায়নি। কিন্তু যখন বামফ্রন্ট সরকার এদিকে ঝুঁকলো তখনই মমতা ব্যানার্জি তার বিপন্ন পলিটিকাল ক্যারিয়ার পুনরুদ্ধারের একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের জন্য আন্দোলনের ডাক দিলেন। অনশন করে একেবারে তোলপাড় ফেলে দিলেন। বামফ্রন্ট তার সঙ্গে আলাপে রাজি হলো। কিন্তু মমতা যখন জনসমর্থন পেয়ে গেছেন তখন আর ভয় কীসে। তিনি আর তাদের তোয়াক্কা করলেন না।
সিপিএম তৃণমূল তো দূরের কথা রাজ্যে তাদের মতার শরিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে বিশেষ কথাবার্তা বলেনি। আর এসইজেড হিসাবে এমন একটা এলাকাকে বেছে নিয়েছে যেখানে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল। সাংগঠনিক শক্তি কম। হয়তো নিজেদের পরীক্ষিত ঘাঁটিগুলোর কৃষকদের তারা ক্ষেপাতে চায়নি। ফলে, সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামকে বেছে নিয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের অনেক আগে থেকেই নন্দীগ্রামে পুলিশের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বিরোধীরা সেখানে গ্রামবাসিদের সহযোগিতায় শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছিল। সিপিএম কোনো দায়িত্বশীল আচরণ না করে। পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের সহযোগিতায় ওখানে তাদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চেয়েছিল। এটা করতে গিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর নির্বিচারে গুলি করেছে। অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত, নিখোঁজ হয়েছেন। নারীরা ধর্ষিত হয়েছেন। সিবিআই তদন্ত করে তাৎণিকভাবে কিছু আলামত পেয়েছে যাতে সিপিএম ক্যাডাররা গুলি চালানোর সাথে জড়িত এমন প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু কালকে সিপিএম নতুন এক ভিডিও চিত্র আদালতের উপস্থাপন করেছে। ওই ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে স্পষ্টভাবেই গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে শিশু ও নারীদের মানব ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সিপিএম নন্দীগ্রাম থেকে বেশকিছু নারীকে কলকাতায় এনেছে। বৃন্দা কারাত বলেছেন, নন্দীগ্রামে যদি পুলিশ যেতে না পারে তবে এদের নিরাপত্তা কে দেবে?
এই নারীদের কয়েকজন বলেছেন, তৃণমূল কর্মীরা তাদের স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। নির্যাতন করেছে। আগুন লাগিয়েছে। ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনাও ঘটিয়েছে।
বোঝা যায়, গরীব মানুষ, তাদের সাধের জমি নিয়ে কি নোংরা রাজনীতিই না চলছে।
নন্দীগ্রামে অধিগ্রহণ আপাতত বন্ধ। মনমোহন সিং একে দুঃখজনক বলেছেন। কিন্তু শিল্পায়ন কি বন্ধ হবে? টাটারা কি ফিরে যাবে? কৃষকের জমি হারানোর প্রক্রিয়া বন্ধ হবে?
বলা হচ্ছে এসইডেজ ও ভূমি অধিগ্রহণ নীতিকে নতুন করে বিচার করা হবে। কিন্তু তাতে করে শেষ পর্যন্ত কৃষকের রাগ কি প্রশমিত হবে?
এনডিটিভির উই দি পিপল অনুষ্ঠানে মেধা পাটকর খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যু তুলেছিলেন। ওইখানে উপস্থিত সিভিল সোসাইটির অনেকেই ছিলেন শিল্পায়নের পক্ষে, তারা হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করছেন কিন্তু চাচ্ছেন আলাপ-আলোচনা ও সঠিক নীতির ভিত্তিতে শিল্পায়ন হোক। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ যেখানেই একরের পর একর জমি নিয়ে কারখানা গড়ে তোলা হবে সেখানেই কৃষিজমি দখল করতে হবে। গ্রাম উচ্ছেদ করতে হবে। কৃষক জমি হারাবে, কাজ হারাবে, বিপন্ন হবে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তো আর কৃষকের জমি আর কারখানা একসাথে রাখা যাবে না। এটা সাংঘর্ষিক। পরস্পরবিরোধী বিষয়। ফলে, কারখানা তৈরি করতে হলে কৃষককে উচ্ছেদ হতেই হবে। কিন্তু কৃষক কেন কারখানার জন্য তার জমি ছাড়বে? রাষ্ট্রই বা কেন কৃষককে জমি ছাড়তে বাধ্য করবে? কৃষক যদি বোঝে কারখানায় তার কাজ মিলবে। এ জমি গেলেও অন্য জমিতে উৎপাদিত শস্যে তার পেট ভরবে। অথবা কারখানাটা কৃষিভিত্তিক তবে না সে কিছুটা আস্থা পাবে। কিন্তু মালটিন্যাশনালরা যে কারখানা তৈরি করতে উৎসাহী তাতে কর্মসংস্থান হবে না। উৎপাদিত পণ্যের সাথে স্থানীয় বাজারের সম্পর্ক থাকবে না। কাঁচামালও স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হবে না। জমি উচ্ছেদ করে সুগার মিল বসালে এক কথা, মোটর গাড়ি স্থাপন করলে আরেক কথা। কিন্তু আমাদের মুর্খ কর্তারা সাবাইকে মুর্খ বানানোর জন্য বলতে থাকেন, বিনিয়োগ আসছে। কোন বিনিয়োগ কিসের বিনিয়োগ কী শর্ত, পরিবেশের ওপর প্রভাব কী কিচু নিয়ে আলোচনার দরকার নাই। টাটা আসছে জমি দাও। যা চায় তাই দাও। যে শর্তে চায় সে শর্তেই দাও। কেন?
টাটা আমাদের দেশেও বিনিয়োগ করবে। ভারতের কোম্পানি না হলে এতদিনে তারা গেড়ে বসতে পারতো। পারে নি তাতে কী? পারবে। পারানো হবে। সেক্ষেত্রে নন্দীগ্রামের অভিজ্ঞতা আমাদেরও কাজে লাগতে পারে।
মেধা পাটকর বলছিলেন, বহুজাতিক তোষণের শিল্পায়ন নীতিটা আসলেই গ্রহণযোগ্য নয়।
Foto credit : www.flicr.com