Sunday, January 21, 2007

হাইপার রিয়েল সাইবার স্পেস


মাহবুব মোর্শেদ
(এই লেখাটি লিখেছিলাম ইন্টারনেট শেখার প্রথম পর্বে। ২০০৪ সালে। ডকুমেন্টেশনের খাতিরে এটি ব্লগে আপলোড করলাম। লেখাটি ২০০৪ সালের আজকের কাগজ সূবর্ণরেখা ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। নাম ছিল সাইবার স্পেসে এক চিলতে হাইপার রিয়েলিটি। নামটা ছাড়া এই লেখার কিছুই আর পরিবর্তন করিনি।)


ফ্রেন্ডফাইন্ডারের সাইন আপ বাটন কিক করতেই স্ক্রিনে ভাসতে থাকলো একগাদা অপশন। কী খুঁজছো তুমি। মেল না ফিমেল। বয়স কত থেকে কত? ভেবে দেখো, আমেরিকান সিঙ্গেলদের খুঁজছো না তো? পৃথিবীর অন্য কোথাও অন্য কোনো দেশে তুমি কাউকে চাও? শুধু বলো। তুমি লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, মনোগ্যামিক, পলিগ্যামিক যাই হও না কেন নিরাশ হবে না। শুধু বলো, কি-বোর্ডে আঙুল রেখে শর্টকাট লিখে ফেল, কী চাও। এই মুহূর্তে সারা দুনিয়ায় ৩০,০০০ মানুষ অনলাইনে ফ্রেন্ডফাইন্ডার ব্যবহার করছে। মিলেও তো যেতে পারে তোমার পছন্দের সাথে অন্য কারো পছন্দ। এমন লোভনীয় সব প্রস্তাবে চোখ বন্ধ করলাম। এই যে এক টুকরো সাইবার ক্যাফে বাণিজ্যিক ভবনের এক কোণের একটা রুম ভাড়া করে তৈরি। রুমের ভেতরে আরো ছোট ছোট খুপরি। হার্ডবোর্ড দিয়ে আলাদা করা সাতটি পিসি। তুমি একবার ওই হার্ডবোর্ড ঘেরা ছোট্ট ঘরে ঢুকলেই কিনতে পারো স্বপ্ন, বাস্তবতা, জ্ঞান, বন্ধুত্ব, যৌনতা... হোয়াট নট। চোখ খুলে স্ক্রিনে তাকালাম। মাউসে হাত রেখে স্ক্রিনটাকে নিচে টানলাম। নতুন ঘোষণা, নতুন প্রস্তাব। তুমি কি নতুন কোনো বন্ধু খুঁজছো? হারানো প্রেমিক বা প্রেমিকাকে পেতে চাও? ছোটবেলার কোনো বন্ধুকে পেতে চাও নতুন করে? বন্ধুর সাথে কতদূর এগুতে চাও তুমি? স্রেফ কথা চালাচালি, আইডিয়া বিনিময়, মনের ভাব বিনিময় নাকি ডেটিং পর্যন্ত এগুবে? শুতে চাও? মুখ ফুটে বলো একবার। না তাও করতে হবে না...শুধু টাইপ করে জানাও। কী করতে পারি আমি? মস্তিস্কের গতি দ্রুত হতে থাকলো। মাথায় একগাদা অপশনে কিক কিক করতে করতে হঠাত এক সময় ঘিঞ্জি, দূরের শৈশবে থমকে দাঁড়ালাম। বেশ, ছোটবেলার এক বন্ধুকে খুঁজে পেতে চাই আমি। কুড়ি বছরের দীর্ঘ ব্যবধানে একটি নামই শুধু মনে এলো জাহিন। লিখলাম জাহিন আলম, এজ পঁচিশ থেকে সাতাশ, জন্ম বরিশাল, এখন থাকতে পারে ইউএসএ-তে, অঙ্গরাজ্য বলতে পারছি না, শহর তাও নয়। খুঁজতে থাকলো ফ্রেন্ডফাইন্ডার। হতাশ। কাউকে পাওয়া গেল না। বেশ তুমি কি আরো তথ্য যোগ করতে চাও? জিজ্ঞেস করলো। না আমি বরং কাটছাঁট করতে চাই। লাস্টনেম কেটে দিলাম। আপাতত যে কোনো জাহিন হলেই চলবে। সার্চ রেজাল্ট এবার প্রসন্ন। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার সামনে এখন সাতজন জাহিন। বেশ তো... একে একে সবার তত্ত¡-তালাশ করা যাক। দু’জন ছবি দিয়েছে। বাকিরা বন্ধু হলে ছবি দেবে বলে প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। একজন জন্ম নিয়েছে আমেরিকায়, বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ খুব। মাত্র একজন আছে এখন অনলাইনে, জাহিন ৭৭, বেশ তো দেখাই যাক না কে সে? কিক করলাম তার নামে। তাকে ভড়কে দেবার জন্য লিখলাম, তোমাকে এভাবে এতদিন পর সাইবার স্পেসে পাবো ভাবিনি, তুমি কি আমাকে মনে করতে পারো? মেসেজ পাঠিয়ে অপোর পালা। এই ফাঁকে ইয়াহু মেসেঞ্জার মারফত রোমাঞ্চ অপশনে সিঙ্গেলদের চ্যাটরুমে লগ ইন করলাম। ভেসে এলো পৃথিবীর কয়েকশ, সিঙ্গেল, প্রেমতাড়িত, যৌনতাতাড়িত ছেলেমেয়ের মুখ। সবগুলোই হলুদ। মেসেজ বক্সে তাদের হাজারো আর্তি। নদীর স্রোতের মতো ভেসে যায়। এত কথা, এত সময়, এত আর্তি, ভালোবাসা। সারা পৃথিবীর খোপে খোপে বন্দি লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর একাকীত্বভরা এই কুহকের দুনিয়া। নামে-বেনামে তারা জানিয়ে চলেছে তাদের দীর্ঘশ্বাস, হতাশা, আশা। প্রতি সেকেন্ডে দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে সাইবার স্পেসের অতলে। কখনো মনে হয় এরা কেউ কারো কথা বুঝতে পারছে না, সবাই নিজের নিজের কথা, কাম, ভাবনাকে প্রকাশ করে চ্যাটরুম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কখনো কেউ কেউ কাউকে কাউকে সাড়া দিচ্ছে অদ্ভুত ছদ্মনামের আড়ালে সান্ধ্যভাষায়, গাণিতিক সংকেতে। একজন জিজ্ঞেস করছে, এই চ্যাটরুমে এমন কোনো মেয়ে আছ যে কালো ছেলের সাথে এখনই শুতে প্রস্তুত? ছেলে কি মেয়ে বোঝা কঠিন, এক ছদ্মনাম চার মেসেজ পর সাড়া দিলো আছি। একজন হঠাত জিজ্ঞেস করলো কেনিয়া থেকে কেউ আছেন? শত শত মেসেজ চলে যায়.... না নেই কেনিয়ার কেউ। লিস্ট থেকে একটা নাম পছন্দ করে তাকে লিখলাম, রোজলিন, তুমি যৌনতা ও কুন্ডেরা বিষয়ে কথা বলবে? মেসেজ চলে গেল।
আবার অপো। ফ্রেন্ডফাইন্ডারে কিক করলাম। জাহিন উত্তর দিয়েছে। স্যরি, আই কান্ট রিকগনাইজ য়্যু। আমি উত্তর দিলাম, চিনতে পারবে। আগে ফ্রেন্ডফাইন্ডারের চ্যাটরুমে আসো। মেসেজ সেন্ড করে ইয়াহু মেসেঞ্জারে এলাম। কোনো উত্তর নেই। তবে কি রোজলিন আমার সাথে যৌনতা ও কুন্ডেরা বিষয় আলাপে উতসাহী নয়? হ্যালো রোজলিন, তুমি কি অনলাইনে নেই? কোথাও চলে গেছ? উত্তর নেই।
ফ্রেন্ডফাইন্ডারের চ্যাটরুম। আমি আর জাহিন মুখোমুখি। হতে পারে সে আমার ছেলেবেলার বন্ধু, নাও পারে। নিজের মুখের প্রতিটি øায়ু বিপ বিপ করে অনিয়ন্ত্রিত সংকেত পাঠাচ্ছে, টের পাচ্ছি।
জাহিন তুমি কি ঠাকুরগাঁয়ে কখনো ছিলে?
নাহ্।
স্যরি, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু।
তাতে কী? তুমি খুব নস্টালজিক।
না তা নয় তবে আজ মন খারাপ খুব।
বেশ তো কথা চলুক কিছুণ।
তোমার ছোটবেলা কোথায় কেটেছে?
বরিশাল।
ইউএসএ-তে কেন গিয়েছ?
বিয়ে হয়ে গেল।
তোমার স্বামী?
আছে। পার্সোনাল ম্যাটার, আর এগিও না।
ফ্রেন্ডফাইন্ডারে কী খোঁজো?
সাম ওয়ান টু টক?
অ্যাম আই ওকে?
নো, ইউ আর আনপ্রাকটিক্যাল।
তুমি বললে পর্্যাকটিক্যাল হবো।
আমি তোমার কে?
কেউ না। সব কিছু।
ঠিক আছে। আমি ফ্রেন্ডফাইন্ডারের জাল থেকে বেরোতে চাই... তোমার পার্সোনাল ইমেল?
আমি আমার ইমেল অ্যাড্রেস লিখলাম।
ঠিক আছে। আমি এখন উঠবো। পরে আলাপ হবে।
বাই।
সি ইউ।
এ এক অভাবিত ব্যাপার। তৃপ্তিময়। এত সহজে এমন কখনো ঘটে না। ভেরি কো-ইনসিডেন্টাল। অবাক করা। ইন্টারনেটে অনেকদিন পর আজ একটা সত্যিকার ‘শুরু’ হলো। সাইন আউট করে ফ্রেন্ডফাইন্ডার থেকে বের হলাম। ইয়াহু মেসেঞ্জারে কোনো পাল্টা মেসেজ আছে কিনা দেখতে গিয়ে থমকে গেলাম। জাহিনের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি মেসেজ আসার সংকেত টের পাইনি। একজন গ্লোরিয়া আমার জন্য মেসেজ পাঠিয়েছে।
রোজনিলেন বদলে তুমি কি আমার সাথে কথা বলবে?
আজ ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন কেন, রাশিফলে কী লেখা হয়েছে? মেসেজ বক্সে দ্রুত লিখলাম
হোয়াই নট? সঙ্গে সঙ্গে সেন্ড করে আবার লিখলাম
হেয়ার আর য়্যু ফ্রম?
উত্তর এলো
কোলন, জার্মানি। য়্যু?
বাংলাদেশ। ডু য়্যু লাইক কুন্ডেরা?
ডেফিনিটলি।
গ্লোরিয়ার বাড়ি চেক রিপাবলিক। ’৯০ এর দশকে বাবা-মায়ের সাথে চলে যায় কোলন শহরে। এরপর সেখানেই বাস করছে। মিলান কুন্ডেরাকে তার খুব পছন্দ। সবচেয়ে পছন্দÑ ‘আনবিয়ারএবল লাইটনেস অব বিয়িং’। চেকোশ্লাভাকিয়ায় রাশান সেনাবাহিনী সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের উদ্দেশ্যে যে আগ্রাসন চালায় তাতে ভয়ানক বিরক্ত সে। ওই সময় এবং পরবর্তী পূর্ব-ইওরোপের বিষণœতার সবটাই যে কুন্ডেরা চিত্রায়িত করেছেন তার উপন্যাসে এই ব্যাপারটাই তাকে মুগ্ধ করে। আমি বলি, আমার পছন্দ ‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’। একজন কবি যে আসলে মাতৃগর্ভ থেকেই কবি হয়ে বেড়ে উঠছে, নানা উপলব্ধির সম্মুখীন হচ্ছে, তার ওই কাব্যিক জীবন ভ্রমণটা আমাকে প্রাণিত করে। আলাপ চলতে থাকলো আরো কিছুণ, আরো টুকিটাকি। কিন্তু, সে ইওরোপীয় আর আমি এশীয় বলেই হয়তো ব্যক্তিগত কোনো প্রসঙ্গ উঠলো না। আবার দেখা হবে বলে বিদায় নিলাম পরস্পরের কাছ থেকে।
আবার িি.ি ুধযড়ড়. পড়স। গ্র“প অপশনে কিক। সাইন ইন। অ্যাডাল্ট + বাংলাদেশ। মোট ২৭টি গ্র“প। সর্বোচ্চ গ্র“প মেম্বার ২২৫, হট-উইমেন-এ। শুধু গরম মেয়েরা নয় গরম ছেলেরাও হতে পারো এর গর্বিত সদস্য। শর্ত একটাই, সদস্য হতে হবে। সদস্য না হলে এ গ্র“প সম্বন্ধে জানতে পারবে না কিছুই। ঠিক আছে তা-ই সই। এভাবেই চলছে। দুনিয়া খুঁজে একটার পর একটা গ্র“পের সদস্য হওয়া এবং দু’দিন পর আনসাব্সক্রাইব করা। ইন্টারনেটে হাজার হাজার গ্র“প অন্তর্জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। বিচিত্র তাদের চাহিদা, বিজ্ঞাপন, ব্যবসা, কথাবার্তা, নিট্শে-পছন্দ্ গ্র“প থেকে আন্টিলাভার গ্র“প পর্যন্ত সুদীর্ঘ তাদের ফিরিস্তি। আছে ভুয়া গ্র“প, শুধু বাণিজ্যিক ফেরেব্বাজির জন্য সেক্সুয়াল ফিরিস্তি। দেখাই যাক, হট-উইমেন কী দিচ্ছে? জয়েন দ্য গ্র“প। একগাদা অপশন। নিচে এলোমেলো করে লেখা ঝঈজঅচ। টাইপ করো। হট উইমেনদের দরজা খুলে গেল তোমার জন্য। চাইলে মেসেজ আর্কাইভে গিয়ে পুরনো মেসেজ দেখো। ফটো দেখতে চলে যাও ফটোজ-এ। গ্র“পের সদস্যদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইলে বলো। এখানে, এই গ্র“পে চলছে তেলেসমাতি কারবার। মেসেজগুলোতে আছে নাখাস্তা যৌনগন্ধী কথাবার্তা। বাংলাদেশের হাইকাশ প্রোস্টিটিউটদের ফোন নাম্বার। নানা ব্যবসায়িক আমন্ত্রণ। একজনের প্রতি আরেকজনের অবিশ্বাস। গ্র“পের মেয়েরা আসলে ছদ্মনামে ছেলে কিনা এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। ফোটো অপশনে বাঙালি, ভারতীয়, ইউরোপীয়, আমেরিকান মেয়েদের একগাদা নগ্নছবি। ঘঝট এঅখ ফোল্ডারে কয়েকজন বাঙালি মেয়ে। হাস্যোজ্জ্বল, সুন্দর। দাবি করা হয় এরা স্বেচ্ছায় নিজেদের নগ্নছবি নেটে ছড়িয়েছে। কে কার ছবি কোন ওয়েবে ছড়াচ্ছে। কে কার গোপন ছবি তুলছে। কে কার প-েবিপে কী দাবি তুলছে কিছু বোঝার উপায় নেই। একজন অফার দিয়েছে হোমমেড পর্নোসিডি চাহিদা অনুসারে পাঠাতে চায়। আরেকজন লিখছে, এ মেসেজটা স্পাম ছাড়া কিছু নয়। বেশ তো, চলুক না। আজকের মতো সময় শেষ। অফলাইন জীবনে ফিরতে হবে দ্রুত। নিজের মেইল অ্যাড্রেসে আজ কী কী জমা হলো চেক করে নিয়ে বিদায়। ব্যাক। ব্যাক ব্যাক। ব্যাক। মেইল বাটনে কিক। সাইন ইন। হ্যালো মাহবুব; তোমার জন্য নতুন মেসেজ ২৮। বাল্ক মেইল ১৩। কবিসভা থেকে এসেছে ১০টি। নানাজনের নানা কথা, নানা তর্ক, নানা আবদার। বেশ। নিজের লেখা কবিতা পড়তে পাঠিয়েছে এক কবি বন্ধু। মেসেজের সঙ্গে অ্যাটাচড ওয়ার্ড ফাইল। পরশু আজিজে দেখা হবে কিনা জানতে চেয়েছে অন্য একজন। একটি আন্তর্জাতিক লটারি সংস্থা জানতে চেয়েছে আমি তাদের তোফা অফার গ্রহণ করতে প্রস্তুত কিনা। ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সম? মেইল পাঠানোর টুকটাক কাজ। ব্যাস। ইওর মেল অ্যাকাউন্ট হ্যাজ সাইনড আউট প্রোপারলি। পাক্কা দুই ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট। প্রতিদিনের ভ্রমণ। তবু এক নতুন, কষ্টকর প্রস্থান।
শুরু হলো অফলাইন জীবন। উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে প্রস্থান। বাসায় ফিরতে ফিরতে জীবনের দু’রকম নিয়ম আবিষ্কার করি আমি। অনলাইন এবং অফলাইন। যদি ভাবি, অনলাইন হলো লাইফ তো অফলাইন জীবন হলো নেয়ারার টু ডেথ। কতদিন? কতদিন হলো এইসবের শুরুর? মনে করতে পারি না। নিজের ব্যক্তিগত গুহায় ফিরতে ফিরতে রাত আর দিনগুলোকে কেবলই তারিখবিহীন মনে হতে থাকে। ওই গুহায় ফিরলে শুরু হয় সেলফোনহীন এক রাত। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে হাউ ক্যান আই কনটাক্ট ইউ অ্যাট নাইট? কোনো বিকল্প না রেখে আমি বলি, য়্যু মে কাম ফিজিক্যালি। আমার রাতের জীবনকে বন্ধুদের কাছে প্রাগৈতিহাসিক মনে হয়। তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই তো বছরখানেক আগেও আমি জানতামই না ইন্টারনেট কী? খবর শুনতাম ইন্টারনেটে চীন ও আমেরিকার মধ্যে শুরু হয়েছে রহঃবৎহবপরহব ধিৎ। মনে হতো, এ এক ভয়াবহ ব্যাপার এ দিয়ে শুধু যুদ্ধই করা সম্ভব। শুনতাম চীনেম্যানরা ইয়াঙ্কিদের নেট জ্যাম করে দিয়েছে আর ইয়াঙ্কিরা চীনেম্যানদের। ব্যাস, অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে দু’জাতি। অফিস-আদালত, ব্যবসাপত্র সব লাটে উঠেছে। এরপর শোনা গেল, সমঝোতা হয়েছে। মার্কিন স্পাইবিমান ছেড়ে দিয়েছে চীনারা। হাফ ছেড়ে বাঁচলো ইন্টারনেটের অধিবাসীরা। আরও শুনতাম যে ইন্টারনেট হলো জালিয়াতদের আখড়া। সেখানে দিকে দিকে ওঁৎ পেতে আছে বিচ্ছু আর বাচ্চা পোলাপান। এরা হলো, চোরের ওপর বাটপার। আজ এরা স্যুইস ব্যাংক থেকে কোটি ডলার সরাচ্ছে তো কাল নাসার গোপন কম্পিউটারে ঢুকছে। আজ বিল গেটসের অ্যাকাউন্ট থেকে ভায়েগ্রার মূল্য পরিশোধ করছে তো কাল পেন্টাগনের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করে দিচ্ছে। অনলাইন ব্যাপারটাই আমাকে অস্থির করে তুলতো। কিন্তু আমিও একদিন এক বন্ধুর সহায়তায় চলে গেলাম অনলাইনের খàরে। বন্ধু বললো, তুমি যদি ভাবো এটা ডাকবিভাগ তো ইন্টারনেট হলো ডাকবিভাগ, লাইব্রেরি, বন্ধু, সংবাদপত্র, খেলার মাঠ একে তুমি যা ভাববে এ তা-ই। লাইব্রেরি ঘাঁটতে ঘাঁটতে মেইলে, মেইলে যোগাযোগ করতে করতে চ্যাটিং... তারপর একের পর এক খেই হারানো কাজ, আকাজ। শেষ নেই। নেটে না বসলে আমি ইনড্রেক্স, বন্ধুদের ঠিকানা, ফোন নাম্বার কিছুই পাই না। জানতে পারি না কানাডায় বসে লেখক বন্ধুরা কী লিখছে, ইংল্যান্ডের বন্ধুরা কী নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি রংপুরের কোনো বন্ধুর খোঁজেও মেইলের পর মেইল করা ছাড়া আর কোনো উপায় মনে পড়ে না। ইমেল ছাড়া যেন তথ্যান্ধ, স্মৃতিবধির, যোগাযোগরহিত একেকটি গুহাবাসী প্রাণী আমরা। আমার বন্ধু কাজলকে ভাবলে অবশ্য অন্যরকম মনে হয়। ও নেটে তেমন ইজি ও রেগুলার নয়। নেট নাকি ওকে স্যুট করে না। একটা ছোট্ট সেলফোনেই ওর দুনিয়া। রাত বারোটা বাজতেই ওর ইন্দ্রিয়গুলো সতর্ক হয়ে বারবার সেলফোনের দিকে তাক হতে থাকে। একটা রিং-টোন বাজতেই ও লাফিয়ে ওঠে। ‘ইয়েস’ বাটন টিপে হ্যালো বলে ওঠে। ওর আছে মিষ্টি ‘ইজি টক টাইম’। ওইটুকুতেই সে খুশি। মিনিটগুনে একটু আলাপ, একটু প্রেম, একটু ভালোবাসা, একটু মন খারাপ, একটু সম্ভাবনা, একটু বিপদ ব্যাস। ঘুমিয়ে পড়ো সকালে অফিস, বিকেলে আড্ডা। সারাণ ওর সঙ্গে আছে কেজো, ছোট্ট, মিষ্টি সেলফোন। দ্রুত কাজের কথা, টাকা গুনে প্রেমÑ হয়তো দেখেছো দু’চার ফোটা জলে/চড়–ই পাখির চার সেকেন্ডের øান/আমিও এখন ওই পাখিটির দলে/শুনিয়ে দিলাম চার লাইনের গান।’
শ্যামল যেদিন প্রথম আমাকে শেখালো সার্চ ইঞ্জিন কী, আর কিভাবেই বা প্রতিটা টপিক নিয়ে ঋদ্ধ হয়ে আছে লাখ লাখ ওয়েবসাইট সেদিন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। এ যেন ‘গো-খুরের গর্তে জমা জলে, নত্রের রাখঢাক খেলা চলে।’ ডায়ালজিক পলিফনি, ফার্টিলিটি কাল্ট, গেরিলা ওয়ারফেয়ার কী নেই এতে? সেই সময়টাতে তোলপাড় চলছে বাংলাদেশে। পিন্টু সুমনের সিডি বেরিয়েছে। ভদ্রঘরের মেয়েরা না জেনে শুয়েছিল ওই বদমাশের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে যৌনকর্ম করে সেই সিডি বাজারে ছেড়েছিল সে। ইন্টারনেটেও দিয়েছিল কেউ। একের পর এক এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছিলো তখন ক্যামেরা লুকিয়ে রাখা ছবি তোলা, সিডি করে মার্কেটে ছাড়া, এইসব। একদিন শোনা গেল, সাইবার ক্যাফের ছাদে গোপন ক্যামেরা লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। তখন অনেক জুটি সাইবার ক্যাফের আলো-অাঁধারি, এক চিলতে ঘের দেওয়া জায়গার প্রাইভেসিকে নিজেদের ডেটিংপ্লেস হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। মতলববাজরা সেখানেও বসিয়ে দিলো ক্যামেরা। এক সময় ক্যামেরা চুরি করে ছবি তুলতো। আজ শুরু করেছে ডাকাতি করে ছবি তোলা। ওই ক্যামেরা এখন পুরো দেশে ছড়িয়ে গেছে। ঘরে ঘরে গোপন ক্যামেরা। ঘরে ঘরে ব্লাকমেইলিং। সিডি ব্যবসা। শোনা যায়, হোমমেড পর্নো সিডি’র কাছে হার মানছে বিদেশি পর্নো। আর ওই ক্যামেরার মতা এখন এমনই আকাশচুম্বি যে, ছোট্ট, শান্ত ওয়েব ক্যামেরা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলের বাথরুম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
এসব ভাবলে নৈতিকতার প্রশ্ন তাড়া করে। আমরা কি তবে আনএডিটেড, আনসেনসরড, র এবং প্রিমিটিড কোনো ভাব প্রকাশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি? ক্রমশ আমরা অনেক কিছুর সাথে যুক্ত হচ্ছি। এগিয়ে চলেছি। কোথায় এগিয়ে চলেছিÑ তা জানি না। গতকাল যে খুপরিতে বসে ব্রাউজ করছিলাম, তার পাশের খুপরিতে একটা স্কুল গোয়িং বয় বসেছিল। গোঁফ ওঠেনি। স্কুলব্যাগ নিয়ে খুপরিতে ঢুকেছিল। তার খুপরিতে কিছুণ পর একটা উশখুশ টের পাচ্ছিলাম। আমি জানি না ওই ছেলেটি মাস্টারবেট করছিল কিনা। আসলেই জানি না। আই ক্যান গেজ। কিন্তু নিশ্চিত কিছুই জানি না।
জাহিনের সাথে সময় ঠিক করা ছিল। ওকে নিয়ে রাতে একটু ভেবেছি। কী বলবো ঠিক করে রেখেছি। আর ভেবেছিÑ ওর সঙ্গে আলাপে কনসেনট্রেট করবো। এদিক সেদিক ফালাফালি করবো না। মেসেঞ্জারে লগ ইন করতেই অবাক। জাহিন উপস্থিত। অনলাইন।
‘তুমি দশ মিনিট লেট।’
‘রাস্তায় জ্যাম ছিল।’ মিথ্যা দিয়ে শুরু করলাম।
‘য়্যু স্যুড পে ফর ইট।’
‘স্যুড আই?’
‘ইয়েস’
‘কাল রাতে আমাকে নিয়ে ভেবেছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী ভেবেছ?’
‘য়্যু ফার্স্ট।’
‘আমি ভেবেছি নিজেকে নিয়েÑ তুমি যখন আমার সবটা শুনবে তখন কি তোমার আমাকে ভালো লাগবে?’
‘কেন?’
‘কারণ আমি তো প্রতিবন্ধী, কানে শুনি না।’ আবারও একটা মিথ্যা। আমি জানি না কেন জাহিনের সঙ্গে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে মিথ্যা একটা পরিস্থিতি তৈরি করে ওর প্রতিক্রিয়া যাচাই করতে চাইলাম। জাহিন একটু চুপ থেকে লিখলোÑ
‘অ্যাঅ্যাম স্যরি। কিন্তু তাতে কী। আমাদের বন্ধুত্বের জন্য এটা সমস্যা নয়।’
‘বেশ তো। তুমি কী ভাবলে বলো।’
‘আমার প্রথম প্রেম নিয়ে। তোমার মেইল পেয়ে হঠাৎ অবাক হয়েছিলাম। কোনো প্রেমিক তার হারানো প্রেমিকাকে খুঁজছে নেটে এটা আমাকে বিস্মিত করেছে।’
‘আর আমাকে বন্ধু ভাবলে কেন?’
‘কারণ তুমি নিজের নাম ব্যবহার করেছ। কিছু লুকাওনি।’
‘তোমার কি মনে হচ্ছে না আমি তোমার সাথে মিথ্যা বলছি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘কারণ, আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে চাই।’
আবারও বিশ্বাস, নৈতিকতা ও সততার প্রশ্ন। এই ফ্যান্টাসির দুনিয়ায় কে কাকে বিশ্বাস করে? কে কাকে সত্য বলে? সাইবার স্পেসে হাইপাররিয়েল অভিযাত্রায় বিশ্বাস ধারণাটাই খুব অপ্রাসঙ্গিক, অকার্যকর। জাহিন আমাকে দেখবে না কোনোদিন, আমিও না। আমি যা বলবো আমি তা-ই। জাহিন যা বলবে জাহিন তা-ই। তবু কথা এগিয়ে চলেÑ একদিন, দু’দিন, তিন-দিন প্রতিদিন। জাহিনও কি মিথ্যা বলছে? আমি জানি না। আমার প থেকে আমি বুনে চলেছি মিথ্যা কথার এক সুদীর্ঘ পাহাড়। আমি বধিরÑ প্রতিবন্ধী। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কারও সাথে কথা বলতেই আমি স্বস্তি বোধ করি না। সবার বাঁকা চোখ আমাকে তাড়া করে। তাই ইন্টারনেটের দৃশ্যময় হাইপার-রিয়েলিটিই আমার আশ্রয়। আমি ভালোবাসি দৃশ্যময়তার যাদু। অনলাইন জীবনই আমার স্বস্তি, শান্তি আর পরিতৃপ্তির জীবন। যা কিছু শব্দময় তা আমার অনধিগম্য। শুনেছি যে শব্দদূষণে পৃথিবী বিপর্যস্তÑ আমি কিছুই বুঝতে পারি না এর। জন্মবধির বলে কোনো শব্দই আমি শুনতে পারি না। আর কে না জানে, যে জন্মবধির সে তো বাকরহিত। আমি কথাও বলতে পারি না। আমি পড়তে শিখেছি, লিখতে শিখেছি বধির, বাকরহিত, জন্মান্ধদের স্কুলে। আমার এক জন্মান্ধ বন্ধু ছিল। স্কুল শেষ হলে সে কোথায় চলে গেছে আমি জানি না। আর জাহিন? জাহিন থাকতো আমাদের ঠাকুরগাঁয়ের বাসার সামনের বিল্ডিং-এ। আমি তাকে বন্ধু ভাবতাম। তার দিকে সারাণ তাকিয়ে থাকতাম। কিছুই বলতাম না, তার কাছ থেকেও শুনতাম না কিছুই। শুধু একটাই স্মৃতি তার সঙ্গে আমার। একদিন পথে একা পেয়ে সে আমাকে একটা কদম ফুল উপহার দিয়েছিল। ওইটুকুই। জাহিনকে নিয়ে আর কিছুই মনে পড়ে না। জাহিন ৭৭ এইসব শুনে ভীষণ অবাক হয়। তুমি বধির ও বাকরহিত কিন্তু তুমি আমার সামনে এমন এক জগৎ খুলে দিয়েছো যে, আমি তার সাাত পাইনি কোনোদিন। তোমার সঙ্গে পরিচয়ের আগে ভাবিনি শব্দহীন ও বক্তব্যহীন এক জীবন আছে। তোমার ওই দৃশ্যময় জগতকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আঅ্যাম ইন লাভ।
এক কাজিনের সঙ্গে প্রেম ছিল জাহিনের। ও তখন দেশে। কাজিন বেকার ছিল আর জাহিন ছিল অপূর্ব সুন্দর। কী থেকে কী হয়ে গেল। বাবা-মা আমেরিকা প্রবাসী এক ছেলের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিলো। রূপ নিয়ে সে চলে গেল দূরেÑ আমেরিকায়। কিছু ভাল লাগে না তার। স্বামী ব্যস্ত। কাজ, কাজ আর কাজ। ও কারো সাথে মিশতে পারে না। কাজিনের সাথে যোগাযোগের উপায় নেই। বহুদিনের ব্যবধানে সে এখন কোথায় জানেও না জাহিন।
সাইবার স্পেসের বন্ধুত্ব কতদূর গড়ায়? বিশ্বজিৎ আর অরুণিমা আমাদের খানিকটা দূরের বন্ধু। ওদের দু’জনের পরিচয় নেটে অ্যাডাল্ট চ্যাটরুমে। ওখানকার পরিচয় বিছানা পর্যন্ত গড়িয়েÑ এখন চলছে দাম্পত্যপর্ব। ওদের সঙ্গে দেখা হলে খুব ভালো লাগে। ওরা ওদের বেডরুমের সামনে লিখে রেখেছে ‘সাইবার ক্যাফে’। ওদের নিয়ে মজার একটা ক্যাপশন মাথায় আসে আমার ‘ফ্রম চ্যাটরুম টু বেডরুম’। বিশ্ব’র সাথে দেখা হলে রক্তিমের প্রসঙ্গ ওঠে। রক্তিম বোধহয় বিশ্ব’র ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে নেটে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিল। তার নেট-বন্ধুত্বের পরিণতি জানতে পেরে আমরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। যে মেয়ের সঙ্গে গত ছ’মাস নেটে প্রেম চলছে ওর অবশেষে জানা গেল, সে আসলে একটা ছেলে। প্রতারিত রক্তিমকে সান্ত্বনা জানানোর ভাষাও আমাদের জানা নেই। রক্তিম নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে আর কোনোদিন নেটে বসবে না। সাইবার ক্যাফে দেখলে ওর মধ্যে ব্যর্থপ্রেমের গ্লানি ফিরে আসে। রক্তিমের দিক থেকে ইন্টারনেটকে ভিলেন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। উদভ্রান্ত প্রেম আর যৌনতা রক্তিমকে অন্ধ করে দিয়েছিল। নাকি এ অন্ধত্ব নিবারণেরও কোনো উপায় নেই?
একবার টাইম ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম, ইওরোপ-আমেরিকার বাবা-মায়েরা শঙ্কিত তাদের টিনেজার ছেলেমেয়েদের নিয়ে। কেননা সারাবিশ্বে টিনেজারদের জন্য, টিনেজারদের নিয়ে রয়েছে অসংখ্য পর্নোসাইট। এই সাইটগুলো কৌশলে টিনেজারদের প্রলুব্ধ করে, এক্সপ্লয়েট করে তাদের ছবি, ভিডিও ইত্যাদি দিয়ে গড়ে তুলেছে অসংখ্য ওয়েবসাইট। ওই সময় বাবা-মা-রা সেন্সরশিপের প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করছিলেন তীব্রভাবে। ইউরোপ-আমেরিকার চার্চগুলোও সোচ্চার হয়েছিল এ নিয়ে। তারপর? তারপর আর এ নিয়ে জানা যায়নি কিছুই। ইন্টারনেটেই ইন্টারনেটের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হচ্ছে জনমত। আবার ওই ইন্টারনেটেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে যৌনবাণিজ্য। ইন্টারনেটের অন্তর্জাল ব্যবহার করে গড়ে উঠছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। সারাবিশ্বের প্রতিবাদী মানুষ নেটে-নেটে যোগাযোগ গড়ে তুলে একত্রিত হয়েছিল সিয়াটলে। তখন একবারের জন্য চমকে উঠেছিল পৃথিবী। সেও তো এখন ইতিহাস। তারপর অসংখ্য ঘটনা ঘটে গেল কানকুন থেকে মুম্বাই পর্যন্ত। পরিবেশবাদীরা একত্রিত হচ্ছে, মাওবাদী, মার্ক্সবাদী, লিবারেল ডেমোক্রেট, সোশাল ডেমোক্রেটরা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করছে। ইরাক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শোর উঠেছে, উঠছে। আমাদের এখানেও ছিটো-ফোটা চেষ্টা চলছে না, তা নয়। তবে তা যেন নিজেরই দ্বিধায় দোদুল্যমান।
এখানকার এগিয়ে থাকা মানুষগুলোর গতির উল্টো দিকে সরকার পিছিয়ে যায় ক্রমাগত। সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হবার প্রস্তাব নানান ধানাই-পানাই করে বাতিল করে দেয়। ধূয়া তোলে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্যের নিরাপত্তার, সার্বভৌমত্ব বিপন্নকারী ষড়যন্ত্রের। যেখানে সহস্র মেকি নত্রের (স্যাটেলাইট) সাহায্যে তোলা সম্ভব দুনিয়ার যেকোনো জায়গার পুক্সানুপুক্স চিত্র, চাই কি মাটির তলায় খোঁজা যায় ওসামার মতো ব্যক্তিকে, চাইলে পদাতিক সৈন্য না পাঠিয়েও ধস্ত করা যায় পুরো বাগদাদ। সে দুনিয়ায় কিসের নিরাপত্তা, কিসের সার্বভৌমত্ব? মাথামোটা নীতিনির্ধারকদের চিকন চিকন সিদ্ধান্তে শব্দ করে ক্রন্দন করা ছাড়া উপায় থাকে না। তথ্য তো এখন পণ্যই। ডিস্কেট, সিডি, সিনেমা, সংবাদ, নাটক, সাহিত্য সবই তথ্য। একটা ডরহফড়ংি ৯৮ এর সিডিও তথ্য। অথচ আমরা এই পণ্য উৎপাদনে পিছিয়ে গেলাম চল্লিশ বছর। ভারতের বিজ্ঞানীরা যেখানে সিলিকন ভ্যালিতে দাপুটে ভূমিকায় অবতীর্ণ, এন চন্দ্রবাবু নাইডু’র সাথে দেখা করে যাচ্ছেন বিল গেটস, অন্ধ্রের গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে ইন্টারনেট তখন আমরা কম্পিউটারকে স্রেফ টাইপরাইটার হিসাবে ব্যবহার করে চলেছি। আর গল্প শুনছি, হায়দরাবাদ নামে এক শহর ছিল... ইত্যাদি।
অবশ্য উল্টোপিঠের গল্পও আছে। যে অন্ধ্রের গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিল ইন্টারনেট সেখানেই নাকি কাজ না পেয়ে শতশত কৃষক আত্মহত্যা করেছে। ফলে প্রযুক্তির উৎকর্ষ ভোটের রাজনীতিকে পরাভূত করতে পারেনি, জয়লাভ করেছিল ুধা নিবৃত্তির আকাক্সা। ফলে পতন হয়েছে নাইডু সরকারের। কিন্তু, এই কৃষক-হত্যা আর ুধার জন্য কি প্রযুক্তি দায়ী? নাকি ুধা আর প্রযুক্তিকে মুখোমুখি দাঁড় করাবার রাজনীতি দায়ী? আমাদের এখানে তো প্রযুক্তির বিকাশ, ুধার নিবারণ কোনোটাই ঘটছে না। আমরা কি তবে তথ্যের ভোক্তাই থেকে যাবো? একদল ভোগ করতে থাকবে তথ্যের তেলতেলে মাখন আর অন্যদলের হাড়ের মজ্জা পর্যন্ত শুকিয়ে যেতে থাকবে? নতুন পৃথিবীতে কোনো অবদান, কোনো কারবারই কি থাকবে না আমাদের?
একদিন সোসাইটি অ্যান্ড কালচার চ্যাটরুমে সাইন ইন করে চুপচাপ খেয়াল করছিলাম ওদের আলাপ-আলোচনা। ওই সময় জাতগর্বী কয়েকজন ইওরোপীয় আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশে তাদের জাতির অবদান নিয়ে আলোচনা করছিল। একজন জ্যু, নাম সম্ভবত মিখাইলÑ দাবি করে বসলো, মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলো ইহুদীদের। তখন আমি খুব কষ্ট পেতে থাকলাম। ভাবলাম এমে সেজায়ারের সেই লাইনগুলো ওদের উদ্দেশ্যে লিখি.... ‘যারা উদ্ভাবন করেনি কোনো বারুদ কোনো দিগ্দর্শিকা/যারা পোষ মানায়নি বাষ্প কিংবা বিদ্যুৎ/যারা সন্ধান করেনি সমুদ্রে বা আকাশে/কিন্তু যারা অন্তস্থলে অনুভব করেছিল বেদনার দেশ...’। তখন একজন ব্রিটন দাবি তুললো তারাই সেরা। জার্মান কেউ দাবি তোলার আগে সে দিতে থাকলো ব্রিটনদের আবিষ্কারের দীর্ঘ ফিরিস্তি। শেষে লিখলো, এমনকি যে ইন্টারনেটে আমরা কথা চালাচালি করছি তার শুরুটাও মার্কনির হাতে। এখানে এসে আমি থমকে গেলাম। লিখলাম, ক্রিস, ডু য়্যু নো জগদীশ চন্দ্র বসু? হি ওয়াজ দ্য ফার্স্টম্যান টু ইনভেন্ট রেডিও। ক্রিস একটু থমকালো। কিন্তু, পরণেই গাঁইগুই করা শুরু করলো। অনলাইনে কয়েকজন ইন্ডিয়ান ছিল, তারা আমাকে সমর্থন করলো। ক্রিস তখন কোণঠাসা। এরপর একজন ফ্রেঞ্চ যখন তার জাতির গৌরব বর্ণনা করতে শুরু করলো তখন আমি চ্যাটরুম থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। ফলে, আমাদের শুরুটা তো উজ্জ্বলই ছিল। কিন্তু, কী এক ঐতিহাসিক ভ্রান্তি, বিপর্যয় আর অকর্মণ্যতা আমাদের পেয়ে বসলো যে এক অবদানহীন সময়ে ও জগতে কপর্দকশূন্য ভিুকের মতো এসে দাঁড়ালাম?
ইনফরমেশন সুপারহাইওয়ে ধরে এগিয়ে চলেছেÑ প্রতিবাদী মিছিল, নগ্ন নারীদেহের প্রদর্শনী, হলিউডের সিনেমার নায়ক, ব্যস্ত সেলিব্রেটি লেখক, মিথ্যা-কথার ফুলঝুরি, সংবাদপত্র, কলাম, নতুন নতুন পরিভাষা, নতুন প্রকাশভঙ্গি। দুধ বেচে কেউ মদ খাচ্ছে। মদ বেচে কেউ খাচ্ছে দুধ। গেমিং করতে গিয়ে কেউ পরীায় ফেল মারছে। আবার ইন্টারনেটের দৌলতে কেউ পড়তে যাচ্ছেÑ হার্ভাড, অক্সফোর্ডে। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে রোগ সারাচ্ছে কেউ। কেউ হয়ে পড়ছে জরাগ্রস্ত। বিদেশ এখন অনেক নিকটে। অনলাইন জীবনে কিছুই অগম্য নয়। সবই কাছের। মার্শাল ম্যাকলুহানও এতটা ভাবতে পারেননি। এই নতুন মনস্তত্ত¡ নিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন তত্ত¡। নতুন সংস্কৃতির নতুন বিচার-বিশ্লেষণ। নতুন সমাজের নতুন সমাজতত্ত¡। অনলাইন জীবন রাষ্ট্রহীন, সমাজ-বঞ্চিত। অফলাইন জীবনে রাষ্ট্র এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াচ্ছে আমাদের। অনলাইনে যে কেউ মুহূর্তেই হতে পারে রাষ্ট্রদ্রোহী। রাষ্ট্র তাই সেখানেও বসাতে চাইছে পুলিশ। কিন্তু কতটা পুলিশ বসালে অনলাইনে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কায়েম হয়? অনলাইনে পুলিশ বসালেÑ অনলাইন দুর্নীতিও হয়তো বেঁধে ফেলবে আমাদের। রাষ্ট্রহীন দুনিয়ার নাম ইন্টারনেট। রাষ্ট্র তো ভীত হতেই পারে। তবুও একটি নাম আমাদের বেদনাবিদ্ধ করেই চলেছে, সে নাম পার্থ সাহা। সারাবিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বোমা ফুটছে বাংলাদেশেও। নাশকতা, গণহত্যা সবকিছুর আন্তর্জাতিকায়ন ঘটছে। এখন শুরু হচ্ছে মেইলে হুমকি দেয়া। নামে-বেনামে নাশকতার দায়িত্ব স্বীকার করা। তবু পার্থ সাহার অপাপবিদ্ধ মুখ আমাদের বেদনাবিদ্ধ করে চলে।
কাল মেইলে জাহিনের চিঠি এসেছে। এতদিন শ্রবণ ও বাকশক্তিসম্পন্ন লোকদের সাথে কথা বলতে বলতে আর শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে উঠেছি। তুমি আমাকে তোমার শ্রবণ ও বাকহীন জগতের ভাষা শেখাও। আমি দৃশ্যময় জগতের ভাষাই শুধু জানতে চাই। তুমি সংকেত পাঠাও। তুমি হয়তো জানো না আমার বেদনায়ময় একঘেঁয়ে প্রবাসে স্বামী ও এক চিলতে স্বচ্ছল সংসারের নৈমিত্তিকতায় তুমি এক বিস্ময় হয়ে উপস্থিত হয়েছ। আমি তোমাকে জানতে চাই, তোমার চোখ দিয়ে চিনতে চাই নিজেকেÑ পৃথিবীকে। জানি, তোমার জন্য এটি নতুন কোনো সান্ত্বনাই বয়ে আনবে না। কেননা আমি তোমাকে ছোটবেলায় কোনো কদমও দেইনি কখনো। তোমাকে সান্ত্বনাই বা দেব কী? তুমিই বরং আমাকে সান্ত্বনা দিও। প্রতিদিন মেইল করো আর চ্যাটরুমে এসো। আমার জন্য। মিথ্যা করে হলেও আমাকে তোমার শৈশবের হারানো বন্ধু ভেবে। আমি খুব অপরাধীর মতো লিখলাম হ্যাঁ। ইয়েস।
আত্মীয়তাহীন পৃথিবীতে আত্মীয়তা, হৃদয়বত্তির উৎসার আর ভালোবাসা-যৌনতার প্রকাশ আমাকে ভাবিয়ে তোলে। রিয়েল, অরিজিনাল, পার্মানেন্ট, ইত্যাকার শব্দের পাশে আমি ননরিয়েল, ভার্চ্যুয়াল, ইরেজিং ইত্যাদি শব্দ পরপর তৈরি করি। বস্তু জগতের পাশে জমা হয় একটা অনুজগৎ। মহাপৃথিবীর স্পেসের পাশে গিগা গিগা স্পেস। প্রিয় বান্ধবীর পাশে দেখতে পাই ভার্চ্যুয়াল গার্লফ্রেন্ডেকে। নব-আবিষ্কৃত ‘গার্লফ্রেন্ডে’র দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, বেদনা-মানুষের সকল অনুভূতিই হয়তো একদিন কম্পিউটার প্রোগ্রামে সাড়া দেবে! বিষণœতার মুহূর্তে কাঁধে এসে হাত রাখবে অলীক গার্লফ্রেন্ড। যৌনকর্মের বদলে øায়ুতন্ত্র পেয়ে গেছে যান্ত্রিক কোনো সঙ্গ বা অনুষঙ্গ। কিন্তু এসবের শেষ কোথায়? আজ হয়তো জাহিন, কিন্তু কালই কি আমি ভুলে যাব না তাকে গত পরশুর আসফিয়ার মতো। সব কিছু ইরেজিং। বছরের পর বছর যেসব চিঠি আমরা চন্দন কাঠের ছোট্ট বাক্সে জমা করি; দুর্বল, ভেজা ভাঁজ খুলে সাবধানে পাঠ করি। সেসব ইরেজিং ইমেলের চাপে ফুরিয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। কবে আপনি শেষ চিঠি পেয়েছেন? কবে আমাদের ঠিকানায় চিঠির বদলে মেইল আসতে শুরু করেছে? মেইল কি দীর্ঘস্থায়ী ? মেইল কি নিমেষে শত শত মেইলের আড়ালে চাপা পড়ে যায় না। মেইল কি ডিলিট হয়ে যায় না মাউসে দু’টো আঙুল ছোঁয়ালেই? তবু জাহিনের সাথে চ্যাট, জাহিনের মেইল সব আমি জমা করে রাখি। ইন্টারনেটেই আমার চন্দন কাঠের বাক্স, সেই আমাদের পুরনো, ছেঁড়া ছেঁড়া, ভেজা চিঠি।
আজ হয়তো আমরা বাংলাদেশে বসে টের পাচ্ছি না। কিন্তু এখানকার পুরনো, সনাতন সমাজের মধ্যে থেকেও আমাদের নতুন একটা সমাজ গড়ে উঠছেÑ সেটা হয়তো ইনভিজিবল, হয়তো আকস্মিক বা ভার্চ্যুয়াল কিন্তু সেটাও সমাজ। নতুন একটা আইডিয়া।

2 comments:

Anonymous said...

N gulo charai pora jabe.

Anonymous said...
This comment has been removed by a blog administrator.