১৪ জানুয়ারি ২০০৮ ঢাকার ল্যাবএইড হসপিটালে মারা গেলেন নাট্যকার, লেখক ও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির প্রফেসর সেলিম আল দীন। তার জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট, ফেনী জেলার সেনেরখিলে। তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। যৌবনে তিনি ঢাকা ও টাঙ্গাইলে ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেয়ার পর সেখানেই আমৃত্যু বসবাস করেছেন।
ইউনিভার্সিটি জীবন থেকে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। পথনাটক আন্দোলনের মাধ্যমে নাটক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। নাটক লেখার পাশাপাশি গড়ে তোলেন নাটকের দল ঢাকা থিয়েটার। মূলত তার ও নাসির উদ্দিন ইউসুফের উদ্যোগে স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের বিখ্যাত নাট্যদল ঢাকা থিয়েটার। দেশীয় ধারার নাটক চর্চার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ শুরু করে ঢাকা থিয়েটার বাংলাদেশের নাট্য জগতে নতুন একটি গতি তৈরি করেছিল। তৈরি করেছে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলী। সেলিম আল দীন পরবর্তী নাট্যকারদের অনেকেই নাটকের বিষয় ও আঙ্গিকের দিক থেকে সচেতনভাবে তার অনুসারী হয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগটি প্রতিষ্ঠিত হয় তার উদ্যোগেই। বাংলাদেশে ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে এটিই নাট্য শিক্ষার প্রথম উদ্যোগ। দেশীয় আঙ্গিকের নাটকের ধারা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে গঠন করা হয় গ্রাম থিয়েটার। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো নাট্য চর্চায় গ্রাম থিয়েটার বেশ প্রভাব ফেলেছিল। সেলিম আল দীনের প্রায় সব নাটক মঞ্চস্থ করেছে ঢাকা থিয়েটার। গ্রাম থিয়েটারের শাখাগুলোও তার বিভিন্ন নাটক মঞ্চায়িত করেছে। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির নাট্য ল্যাবরেটরিতেও তার নাটক অভিনীত হয়েছে। কলকাতার বহুরূপী থিয়েটার তার একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছে। নাটকগুলোর মধ্যে কীত্তনখোলা, চাকা, হাতহদাই, কেরামতমঙ্গল, যৈবতী কন্যার মন, মুনতাসীর, চাকা, প্রাচ্য, বনপাংশুল বিশেষভাবে আলোচিত। ঢাকা থিয়েটার সবশেষে মঞ্চস্থ করেছে তার নিমজ্জন নাটকটি। কথানাট্য, পাচালি প্রভৃতি আঙ্গিক চর্চার পাশাপাশি তিনি প্রবন্ধ, গবেষণা প্রবন্ধও লিখেছেন।
মঞ্চ নাটক ছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য প্রচুর টিভি নাটক লিখেছেন তিনি। মুভির জন্য চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। তার নাটক চাকা ও কীত্তনখোলা থেকে মুভি তৈরি হয়েছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি, ইনডিয়ার বিশ্বভারতী ও যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে তার নাটক ও নাট্য বিষয়ক গবেষণা পড়ানো হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ সময়ের অপ্রতিরোধ্য নাট্য প্রতিভা সেলিম আল দীন। স্বদেশ, স্বকাল, ইতিহাস ও সময়ের নিরন্তর প্রবাহের ভেতর তার অন্বেষণকে সাহিত্যের মানুষেরা নিরন্তর শ্রদ্ধা করে এসেছে। জীবিত অবস্থায় লেখা, লেখার জন্য সাধনা ও সার্বক্ষণিক শিল্পবোধ তরুণ লেখকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। নাট্য আঙ্গিকের ক্ষেত্রে, নাট্য গবেষণার মোড় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এবং নাট্যের বিষয় ও ল্যান্ডস্কেপের বিশালত্বের ক্ষেত্রে তার কৃতি ও কৃতিত্ব ব্যাপক। মানব চরিত্রের গভীর ও ব্যাপক অনুসন্ধান তিনি লোকমানসের ভেতর করেছেন। কিন্তু গুটিকয়েক গতানুগতিক একাডেমিক গবেষণা ছাড়া সেলিম আল দীনকে মূল্যায়নের প্রচেষ্টা সচরাচর দেখা যায় না। মৃত্যুর পর লেখক সেলিম আল দীনের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিচয়কে তার লেখার মধ্য দিয়ে অন্বেষণ করার নতুন সম্ভাবনা হয়তো তৈরি হয়েছে। এতোদিন না হলেও আশা করা যায়, এখন সম্ভব হবে তার লেখার যথার্থ নান্দনিক বিচার।
২০০০ সালের আশ্বিনের রৌদ্র ঝলসিত এক দুপুরে সেলিম আল দীনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কবি, গল্পকার ও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগের শিক্ষক রায়হান রাইন, নাট্যকার ও গবেষক সাইমন জাকারিয়া এবং মাহবুব মোর্শেদ। এ সাক্ষাৎকারটি যখন নেয়া হয় তখন তিনি রুক্নবর্ণ নামে একটি নাটক লিখছিলেন। তিনি বলতেন এটি আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তিমূলক একটি লেখা। রুক্ন শব্দের অর্থ সোনা। প্রায় দেড়শ পৃষ্ঠা লেখার পর লেখা বন্ধ করে দেন তিনি। বছর খানেক পর সেই একই আইডিয়া নিয়ে নতুন আরেকটি নাটক লেখা শুরু করেন। নাটকটির নাম নিমজ্জন। নিমজ্জন লেখার আগে পরে তিনি আরেকটি নাটক লেখার কথা বলতেন। নাটকটির নাম দিয়েছিলেন ময়ূরযান। নিমজ্জন লেখার পরবর্তী সময়গুলোতে তিনি ধাবমান, স্বর্ণবোয়ালের মতো নাটক লিখলেও ময়ূরযান আর লেখেননি।
সাক্ষাৎকারটির বর্ণনা দিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ।
নিমজ্জন ও রুক্ণবর্ণ
‘রুক্ণবর্ণ লেখা সংক্রান্ত একটা প্রশ্ন দিয়েই শুরু করতে চাই। সে সময়ে আমি আপনার সঙ্গে ছিলাম। আমার প্রশ্ন হলো, একটা সময়ে এসে আপনি রুক্ণবর্ণ লেখা বন্ধ করলেন এটা কোন কারণে?’ আমি প্রশ্ন করি।
সেলিম আল দীন কথা শুরু করেন, ‘আমার মনে হয় লেখক জীবনের একেকটা পর্বে একজন লেখককে বাধ্য হতে হয়, এটা অনিবার্য, এটা লিখতে হবে আমাকে। সে তাগিদটা যখন প্রবল একটা আকাশের মতো হয়ে যায়, প্রবল হয়ে ওঠে তাগিদটা, তখন নিশ্চিতভাবে একজন লেখক লিখতে বাধ্য হন। রুক্ণবর্ণের ক্ষেত্রে বলা যায়, এটি আমার সবচেয়ে কাছাকাছি আত্মজৈবনিক লেখা। যে কোনো লেখাই এমনকি পৃথিবীতে যেসব লেখাকে ডিটাচড বাই ইমপারশিয়াল আর্টস যেগুলোকে আমরা বলি, সেগুলোও এক ধরনের আত্মজৈবনিকতা আচ্ছন্ন। সেটি বোঝার উপায় নেই। কারণ লেখক যা কিছু ভাবেন- সেটা তার জীবনের মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করেন বলেই ভাবেন, সে অর্থে এটা তার জীবনেরই অংশ। কাজেই ইডিপাস বলি বা আইসখলুসের নাটক যদি আমরা ধরি- যদিও তাকে ডিটাচড মনে হচ্ছে অন্যের কাহিনী তবু তা আত্মজৈবনিক।’
‘এটা কি চিন্তার কারণে হয়’ সাইমন জিজ্ঞেস করলেন।
'না। এটা হয় অংশগ্রহণের কারণে। ওটা এতো বেশি সত্য হয়ে যায়- যে বোধটা তার ভেতর উদ্ভূত হলো সে বোধটা সে এতোটা প্রচ- শেয়ার করে যে ওটি সে কারণে একটি প্রচ- লেখা হয়ে যায়। অসাধারণ লেখা হয়। অসাধারণভাবে শেয়ার করার কাজটি তার জীবনের অংশে পরিণত হয়। হতে পারে সেটা ইডিপাস, হতে পারে সেটা মিডিয়া, ইলেকট্রা, ওয়েস্তেস কিংবা হ্যামলেট। এভাবে এক ধরনের দূরবর্তী আত্মচারিতা কিন্তু ওর মধ্যে ঘটে। যদিও আমরা সেটা সহজে খুজে পাই না। রুক্নবর্ণ কিন্তু আমার অন্যান্য নাটকের তুলনায় অনেক বেশি কাছের। আমার ভেতরে শিল্পের উত্থান-পতন, আমার অগ্রসরমানতা, আমার কালের গহ্বরগুলো, আমার পতন, দুর্বলতা এগুলো মিলিয়ে একটা সম্পূর্ণ আমির দিকে যাত্রা শুরু। সেজন্য আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, অবিরল একটা ক্রুশ কাঠ কাধে নিয়ে চলেছে অগম্য পথে, কালের পথে, সময়ের পথে ভবিষ্যতের দিকে, কিংবা তার গন্তব্যে। সুতরাং অন্যান্য লেখার চাইতে রুক্নবর্ণ নিশ্চিতই আমার জীবনের কাছাকাছি লেখা হয়ে ওঠে।'
'রুক্নবর্ণে আপনার অনেক স্বীকারোক্তি আছে। লেখক হিসেবে মানুষ হিসেবে' আমি মন্তব্য করি।
'একটা আত্ম উপলব্ধির ব্যাপার ঘটে। আমার মনে হয় সব লেখকেরই নিজস্ব আত্মউপলব্ধির একটা চূড়ান্ত জায়গা তৈরি হয় সেটি বোধহয় চল্লিশের পরে পঞ্চাশের মধ্যে ঘটে কিংবা তারও খানিক পরে ঘটতে পারে। কিন্তু ঘটে যায়। এ আত্মউপলব্ধিটা কোনো না কোনো লেখায় ধরা পড়ে। আমরা টলস্টয় সম্পর্কে জানি যে, আত্মউপলব্ধির চূড়ান্তে তার উচ্চারণগুলো ঋষিতুল্য, সন্ততুল্য হয়ে যায়। আমরা এও জানি যে, রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলিতে এক বিশাল ঈশ্বরকে আবিষ্কার করেন, রৌদ্রে, শরতে, বর্ষায়, সভ্যতার সংঘাতে, নানাভাবে ঈশ্বরের লীলায় তার চিত্ত দোলে। দুলে ওঠে। সব লেখকেরই একটা আত্মজৈবনিকতার অংশ থাকে তার শিল্পের মধ্যে। চিত্রকলায়ও তাই।'
'এই লেখাটা তাহলে বন্ধ করলেন কেন?' বললেন রায়হান রাইন।
'প্রশ্নই ওঠে না। লেখাটি রাফলি শেষ হয়েছে, কমপ্লিট করার অপেক্ষায় আছি। ধরে নিচ্ছি, আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের কোনো একটি পরীক্ষায় রুক্নবর্ণের অংশবিশেষ অভিনয় করবে। আমার মনে হয় রুক্নবর্ণে আমার টোটাল নির্মিতি এখনো পেকে ওঠেনি। কিন্তু কাজটা শেষ হয়েছে। এটা অনেকটা দিওনুসিসের মতো যে, জিউসের থাইয়ের মধ্যে অপরিপক্ব ভ্রুণটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হচ্ছে। কাজেই এটা আমার থাইয়ের মধ্যে কেটে রেখে দিয়েছি এবং শিগগিরই সেটি ভূমিষ্ঠ হবে। আমার ঊরু থেকেই।
ভ্রুণ প্রসঙ্গটি ধরে সাইমন প্রশ্ন করলেন, 'ভ্রুণ প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল তখন আরেকটি প্রশ্ন করি। আপনার নাটকে ভ্রণ প্রসঙ্গটি একটি বিশাল বিস্তৃতি নিয়ে দেখা দেয়। কেরামতমঙ্গলে আমরা এটা দেখি, বনপাংশুলে দেখি। এটা কেন বারবার আসছে?'
'ভ্রণ তো জীবনের একেবারে সূচনা। আমাদের এই অভিশপ্ত পৃথিবীতে এই জন্মটাই অভিশপ্ত হয়ে ওঠে। সেটি হওয়ার কথা নয়। এটি বৃক্ষের মতো, নতুন সজীব কুড়ির মতো, একটা হিল্লোলিত সময়ের ফসল হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে ভ্রণটা আমাদের এখানে অভিশপ্ত হয়ে ওঠে, আমাদের এই নরকবেষ্টিত সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থায়। সেই হিসেবে ভ্র'ণ তো যে কোনো কবিরই একটা অন্বেষণের বিষয় হতে পারে। উদ্দীপনার বিষয় হতে পারে। কারণ আমি যখন কবিতা লিখছি, সেটিও কিন্তু ভ্রণ অবস্থায় থাকছে, অঙ্কুর অবস্থায় থাকছে। মানবজন্মের ক্ষেত্রে এটি তো আরো দৃশ্যমান। আমার ব্যক্তিগত সাফারিংয়ের ব্যাপার হলো যে, আমার প্রথম সন্তানটি অপরিপুষ্ট ভ্রণ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। এই সময় নাসির উদ্দিন ইউসুফেরও একটি বাচ্চা অকালে মারা যায়। এই সময়ে আমার হঠাৎ মনে হলো, এমন একটি ভ্রাম্যমাণ চরিত্র হতেই পারে, যে জীবনে এই ভ্রণ বিনষ্ট দেখছে আর আর্তনাদ করছে। সেখান থেকে সামাজিক-রাষ্ট্রিক বিষয়ের মধ্যে এটাকে স্থাপন করলাম। তদ্দিনে মাদার টেরেসা ভ্রণ বিনষ্টির বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন শুরু করেছেন সারা পৃথিবীতে। আন্তর্জাতিক এ ঘটনাটাও আমাকে ভাবিয়ে তোলে। আমার ইচ্ছা ছিল এটি মাদার টেরেসার সামনে অভিনীত হোক। দেখলে তিনি অবশ্যই খুশি হতেন। '
না লেখা নাটক ময়ূরযান
মানব ভ্রণ থেকে লেখা ভ্রণ প্রসঙ্গে আসি। আপনার সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয় হয় তখন থেকে আপনি একটা লেখার প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন সেটা ‘ময়ূরযান’। ময়ূরযানের কথা আপনি ঘুরেফিরে অনেক সময় বলেছেন। লেখার ভ্রণ নিয়ে লেখক যখন তিন-চার বছর থাকেন সেই অনুভূতিটা কেমন? ময়ূরযান লেখার এই যে ভার, আইডিয়ার যে ভার, এই বিষয়টা ব্যাখ্যা করেন। বললাম আমি।
বিষয়টা আমি একটা প্রতিতুলন্যাস করতে পারি। ডেভিলস হাউস বলে একটা উপন্যাস আছে, দস্তয়েভস্কির। আলবেয়ার কামু এটা পড়েন এবং এতোটা পছন্দ করেন যে প্রতি মুহূর্তেই তিনি ভাবছিলেন এর একটা নাট্য রূপ দেবেন। বহু বছর পরে তিনি দি পজেসড বলে একটা নাটক লিখলেন। এখন এই লেখার ব্যাপারটি হলো যে আমি একটা ছাচ বা একটা বোধে উপনীত হয়েছি। ময়ূরযান নিয়ে আমার চিন্তাটা ৬-৭ বছর হয়ে গেল। যৈবতী কন্যার মন ও হরগজ লেখার পর আমার মনে হয়েছিল আমি দ্রুত এটা লিখে উঠবো। একদিন বৈশাখের রাতে অকান্ত বৃষ্টিতে একা একা ভিজেছি ইউনিভার্সিটির রাস্তায়। কেউ জানে না। ইউনিভার্সিটি তখন বন্ধ। এক সঙ্গী নিয়ে, হাতে ছাতা। যদি কেউ দেখে যে স্যার এভাবে বৃষ্টিতে রাতে হাটছেন। বিষয়টা বর্ষাকাব্য হবে। যেমন শরতের ওপর একটা নতুন লেখা লিখছি। শরৎ সম্ভোগ এই ধরনের বিষয় হবে। নামটা এখনো ঠিক করিনি। ঋতু নিয়ে আমার প্রচ- একটা আবেগ আছে। এবং সভ্যতা নিয়েও আমার একটা আবেগ আছে। সেটারই একটা ক্রিয়েটিভ রূপ আমি হয়তো ময়ূরযানে তুলে ধরবো। আমার লেখায় দেশকাল সচেতনতাটা থাকে কিন্তু তার মুখটা ফেরানো থাকে সভ্যতার দিকে। হরগজের কথা বলতি পারি, ওটি কোনো বিশেষ অঞ্চলের ঘটনা বটে, আবার একেবারে বিশেষ অঞ্চলের ঘটনাও নয়। সুইডিশ একটা পত্রিকায় এর অনুবাদ পড়ে সমালোচক লিখছেন যে, এটি কসোভোর গণহত্যা স্মারণ করিয়ে দেয়। লেখাটা (ময়ূরযান) লিখছি না, কিন্তু কখনো কখনো মনে হয় লেখাটা হয়ে গেছে। এ রকম একটা ইলিউশনেও আমি মাঝে মধ্যে ভুগি।
এই যে লেখাটা শেষ হলো না, লেখাই হয়নি আদৌ। এর একটা দহন আছে তো। লেখক হিসেবে সেই ফিলিংসটা কেমন? প্রশ্ন করলাম আমি।
দহন না রীতিমতো, কোনো একটা লেখা লিখতে যেটা করা, মনে হচ্ছে প্রতি মূহূর্তেই আমি একটা ব্যভিচারে লিপ্ত। আমি একটা ভয়ঙ্কর পাপ করছি। ভ্রণ হত্যার মতো ভয়ঙ্কর প্রচ- অপরাধ জন্মায়। লেখককে বোধহয় এটা তাড়িয়ে বেড়ায়, রবীন্দ্রনাথ একটা গানে এ রকম বলেন যে, সুর ভুলে যে ঘুরে বেড়াই কেবল কাজে/ তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে বুকে বাজে। সুর ভোলাটা এ রকম যে থিম এলো, বোধটা এলো অথচ তুমি অগ্রসর হচ্ছো না। তখন ওই ভর্ৎসনা কিন্তু নিজের মধ্যে কাজ করে।
প্রাচ্য
‘প্রাচ্য’ নাটকটিকে আপনি বলেছেন স্ট্রাকচারাল এপিক। আমরা যতোটা বুঝেছি এপিক ... রাইন প্রশ্ন শেষ করার পূর্বেই সেলিম আল দীন বললেন,
‘যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে এ বিষয়ে মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, শিবাজি বন্দোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন এদের সঙ্গে আমার একটা তুমুল বাগযুদ্ধ হয়েছিল। আমি খুব অ্যারোগেন্টলি বলেছিলাম যে আসলে রামায়ণকে আমাদের জাতীয় কাব্য রূপে গ্রহণ করার কোনো উপায় নেই। প্রয়োজনও নেই। তাহলে আমরা ‘বিষাদ সিন্ধু’ অথবা ‘পদ্মাবতী’কে আমাদের এপিক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ধর্ম একটি বিষয় বটে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাঙালিমাত্রই পাচালি স্ট্রাকচারবটাতে কাব্য রচনা করেছে। সেখানে কিন্তু ধর্মবিভেদ নেই। কনটেন্ট পাল্টে যাচ্ছে, চরিত্রের নাম পাল্টাচ্ছে, ফর্ম কিন্তু পাচালির। কাজেই এই কমননেসটাকে যদি আমরা জাতি বর্ণ নির্বিশেষে গ্রহণ করি, স্ট্রাকচারটাকে যদি ধ্রুব ধরি তাহলে বাঙালির ক্ষেত্রে কৃত্তিবাস থেকে শাহ মুহম্মদ সগীর হয়ে আলাওল থেকে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত একটা স্ট্রাকচার এর অধীনে কাজ হয়েছে। কথকতা যতোটা নয়, ততোটা পাচালি। পাচালির এই সর্বব্যাপ্ত রূপটা তাহলে আমরা অ্যাকসেপ্ট করতে পারি। এই স্ট্রাকচারটার অধীনে যেসব কাব্য লেখা হয়েছে সবগুলোরই এপিক ব্যপ্তি আছে। সে জন্যই আমি বলেছিলাম যে স্ট্রাকচারাল এপিক বিষয়টা ভাবা যায় কিনা। সেক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতায় আমরা ভুগি না আর। কিন্তু তারা বললেন এটার প্রয়োজন কি? তা ছাড়াই তো আমাদের সাহিত্য দাড়িয়ে গেছে নিজের পায়ে। সেটাও সত্যি কথা, কিন্তু কতোখানি নিজের পায়ে সেটা নিজের পায়ের দিকে না তাকালে তো আর বোঝা যায় না।’
‘এই স্ট্রাকচারটা পরিবর্তন না হওয়ার কারণ কি নিম্নবর্গের মানুষের জীবনে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি এটাই?’ রায়হান রাইনের প্রশ্ন।
‘তুমি যেটা বলেছ সেটা একটা সত্যি ঘটনা। আরো বড় ঘটনা হলো, যখন হাজার হাজার বছর ধরে লাখ লাখ মানুষ তাদের জন্য এ বিষয়টিকে সৃষ্টিশীলতার ধ্রুব পদ্ধতি বলে মনে করছে তখন এটাকে সরায় কে?’
‘শিল্পের ফর্ম তো আবার সমাজের সঙ্গে কো-রিলেটেড। সমাজের যখন পরিবর্তন হয়ে গেছে তখন এটা কিভাবে দাড়াবে?’ বলেন রাইন।
‘বাঙালির টোটাল মানসিকতার ভেতরে এখনো যৌথ পরিবারের ধারণা আছে। ভাঙছে অনেক জায়গায় কিন্তু কতো পারসেন্ট ভাঙছে? কাজেই ইওরোপিয়ান স্টাইলে জীবনকে ভাবলে চলবে না। যৌথ পরিবার যতোদিন আছে পাচালির মতো যৌথ শিল্পের প্রেরণাটা আমাদের মধ্যে কাজ করতে পারে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও আমরা দেখছি বাঙালিরা একটা পরিবারের ভববষরহম নিয়ে দেশটা স্বাধীন করেছে। অর্থাৎ পুরো বাঙালি জাতিটাই একটা পরিবার। অবশ্য স্মল এথনিক গ্রুপ যারা তাদেরও আমরা অংশীদার করছি আমাদের ভূখণ্ডে, একই ঐতিহ্যের না হলেও আমরা তাদের ঐতিহ্যকে সম্মান করি, গ্রহণ করি। তারাও আমাদেরটা গ্রহণ করে। আমি এ বিবাদে যাচ্ছি না। আমি বলছি পুরো মানচিত্রটাই একটা বৃহৎ গৃহাঙ্গন। এটা থাকবে চিরস্থায়ী, আমি সেটা বলছি না। কিন্তু বাঙালি সহস্র বছর ধরে পরিবার সম্পর্কে মানুষ সম্পর্কে যে ভ্যালুজ লালন করছে, একজন গ্রিক যেমন হাজার হাজার বছর ধরে বহন করছে-আমরাও তেমনি হাজার হাজার বছর ধরে বহন করছি। আমাদের শিল্প যদি সেই নিরিখে হয় তো মন্দ কি?’
ভাষা
রায়হান রাইন প্রসঙ্গ পাল্টালেন সেলিম আল দীনের ভাষা প্রসঙ্গের উল্লেখ করে। ‘আমরা দেখছি আপনি সবসময় একটা নির্মিত ভাষার পক্ষে। সেটা করতে গিয়ে আপনি সংস্কৃত বহুল শব্দ ব্যবহার করেন এবং প্রচুর পুরনো, অপ্রচলিত শব্দও আপনি ব্যবহার করেন। সেটা সাধারণ যে প্রচলিত ভাষা কাঠামো তার সাথে কতোটা সঙ্গতিপূর্ণ? কিংবা আপনার এই লিখিত ভাষার পরিণতিটা কি?’
“এই ব্যাপারে আমি একেবারে শিল্পপন্থী। দৈনন্দিন ভাষা ব্যবহার করে আমি কাব্য করার পক্ষপাতী নই। সেটা মাত্র বিশ্বাসযোগ্যতার খাতিরে যতোটুকু আসতে পারে। শিল্পের ভাষা সবটাই হবে নির্মিতি। নির্মিতি মানেই কাব্য। গদ্যটা একটা ভান বটে। আমার লেখার গদ্যের যে রূপটা তোমরা দেখো এটি আসলে ছলনা, বেসিকালি আমি কবিতাই রচনা করি। কবিতার ছন্দ, মাপ, স্পন্দন, সব মিলিয়ে কিন্তু আমি গদ্যটা রচনা করি। গ্রামাঞ্চলে প্রচুর শব্দ আছে সেগুলো সংস্কৃত ভেঙে তৈরি। এক জেলায় ব্যবহৃত হয় অন্য জেলায় ব্যবহৃত হয় না। আবার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমি অত্যন্ত সচেতন, ‘হাত হদাই’র মতো লেখা বা আমার যে কোনো লেখাতে যখন আঞ্চলিক ভাষা আসছে, কথ্যভাষা যখন আসছে তখন অবশ্যই সে কথ্য। সেখানে নির্মিতিটা হলো, সেটাকে সম্ভাব্য আঞ্চলিকতার সীমায় রেখে কাব্যরূপ দান করা। সৎভাবে সেটা করা। প্রত্যেক ভাষাই চায় একটা সর্বজন বোধ্যতার দিকে যেতে। চট্টগ্রামের কোনো গায়ক কি আঞ্চলিক ভাষায় গান করে মাইজভাণ্ডার শরীফে। সে কথা বলছে এক ভাষায় কিন্তু এক্সপ্রেশন-এর বিষয়টি আসছে তখন যে সর্বজনমান্য প্রায় সবাই বুঝতে পারে এমন একটি ভাষাকেই সে আশ্রয় করছে।”
‘ভাষার মূল বিষয়টাতো কমিউনিকেশন?’ আমি বললাম।
‘তাহলে, কমিউনিকেশনই যদি বিষয় হয় তবে আমি নির্মিত ভাষায় কেন লিখবো না? যদি কমিউনিকেট করতে পারি প্রচণ্ডভাবে। কমিউনিকেশনের জন্য আমি কতোগুলো কৌশল ব্যবহার করি। আমি এক ধরনের রিদম তৈরি করি যাতে সেটি কানে ঢোকে। একটা স্পন্দন তৈরি করি যাতে এই আধুনিক লোকটি সেটি বুঝতে পারে। আমার মনে হয় আমি বাকি জীবনেও আমার তৈরি ভাষাতেই লিখবো। জনগণের ভাষাকে আমার ভাষা করে আমি লিখবো।’
‘ভাষা নির্মিতির বিষয়টা প্রথম লক্ষ্য করা যায় আপনার শকুন্তলা নাটকে।’ সাইমন মন্তব্য করলেন।
‘শিক্ষানবিসির কালে। লক্ষ্য করবে শকুন্তলার পরে আমি সোজা কীত্তনখোলায় নেমে গেছি। যখন আমি টের পাচ্ছি ভাষার কাসিকাল রূপটা নির্মাণের ব্যাপারে আমার আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, স্বচ্ছন্দ। তখনই আমি কীত্তনখোলার আঞ্চলিক ভাষায় নেমে গেলাম। কীত্তনখোলার ভাষাটা কতোটুকু আঞ্চলিক, কতোটুকু কাসিকাল এ বিষয়টা নির্ধারিত হয়ে গেল। এ বিষয়ে এস এম সুলতানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। থিমের ব্যাপারে তার সঙ্গে আমার মতদ্বৈধতা হয়েছিল। কিন্তু ভাষার ব্যাপারে তার সাজেশনটাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছিলাম।’
‘হাত হদাই’কে আপনি আঞ্চলিক ভাষার কাজ বলছেন কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে এটা আসলে আঞ্চলিক ভাষা নয়। খুব টেকনিকালি কাজটা করা হয়েছে।’ সাইমন বললেন।
‘আমি কোন অঞ্চলের ভাষায় লিখবো? প্রতি তিন মাইল অন্তর ভাষা চেঞ্জ হচ্ছে। আমি আদর্শ ভাষা ধরবো কোনটাকে। এ ক্ষেত্রেও একে জনগণের ভাষা বলে প্রচার না করা ভালো। শিল্পিত ভাষা করতে হলে যদি আরোপিত ভাষা ব্যবহার করতে হয় তো ডু দ্যাট। আর হাত হদাই’তে গল্পগুলো, যেগুলো মঞ্চে ব্যবহার করা হবে সেগুলো বিশুদ্ধ মান্য ভাষায় লেখা হয়েছে বলে ওটি বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’
রায়হান রাইন আবারো বিতর্কের সুর তুললেন, ‘কথা নাট্যে ভাষা বারবার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আপনার ভাষাকে আমাদের এতো বেশি বিচ্ছিন্ন মনে হয়, আলাদা মনে হয় যে, তাকে আমাদের সময়ের ল্যাঙ্গুয়েজ মনে হয় না।’
‘ভাষার একটা সময় তো আছেই। মেঘনাদ বধ কাব্যে আমি লক্ষ্য করেছি (সাম্প্রতিক প্রযোজনায়) অদ্ভুতভাবে চলতি ভাষার ব্যবহার আছে এবং আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার আছে। চলতি বাংলার ব্যবহারটি খুব অসাধারণ। কিন্তু মেঘনাদ বধের শব্দ বিষয় এগুলো কি সমকালীন? অর্থাৎ বিষয়ের সমকালীনতা না থাকা সত্ত্বেও ভাষার সমকালীনতার মধ্য দিয়ে বিষয় আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আবার বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা ভাষাকে যখন তৈরি করে তখন সেটা কালের অপেক্ষা করে না। এখন থেকে চল্লিশ বছর পর সবাই যখন ভুলে যাবে তার আগেই আমার বলে দেয়া উচিত- ডেকো না আমারে ডেকো না/চলে যে এসেছে মনে তারে রেখ না। বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তিটা কালের বটে, কাল নিরপেক্ষও বটে। সহস্র বছরের সেই শক্তিটাকে আমি গদ্যের ছলে পদ্যে ব্যক্ত করেছি। সেটা করতে গিয়ে যদি সমকাল থেকে বিচ্যুতি ঘটে যায় তবে সেটা নিশ্চিন্তে ঘটুক।’
‘আপনি কি মনে করেন আপনার ভাষা কমিউনিকেট করতে পারে?’ প্রশ্ন করলেন সাইমন।
‘কমিউনিকেট যদি না করে তবে তোমরা বসেছো কেন এখানে?’
সময়
আমি প্রসঙ্গ ধরে খানিকটা অন্য দিকে গেলাম।
‘আমরা একটা সময়ে সাহিত্য চর্চা করছি আপনাদের সঙ্গে আমাদের সময়ের দূরত্ব প্রায় ২৫/৩০ বছর। আপনারা একটা বিশেষ সময়কে অতিক্রম করে এসেছেন, আপনাদের সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে সাহিত্য নাটক কবিতাকে নতুন স্থানে স্থাপন করতে হবে- এই প্রেরণা আপনাদের মধ্যে ছিল। একটা বিশেষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আপনারা এই স্থানে উপস্থিত হয়েছেন। আমাদের অভিজ্ঞতাটা ভিন্ন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালিত্ব, নতুন দেশকে গড়া, নতুন দেশের শিল্প সাহিত্যকে গড়া ইত্যাদির যে তাড়না- সেটাও আমাদের মধ্যে নেই। এই জেনারেশন এবং আপনাদের জেনারেশন এ দুই জেনারেশনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো কেমন হয়?
‘আমার মনে হয় যে, আমাদের জেনারেশনেও প্রচুর অনড়তা আছে, ভ্রান্তি আছে। অজ্ঞতা প্রচুর আছে। আবার বৃহৎ একটা গণযুদ্ধে আমরা অংশগ্রহণ করেছিলাম বলে পৃথিবীকে দেখার, বোঝার এবং স্বদেশের মাটিকে অন্বেষণ করার স্পৃহা আমাদের ছিল। পৃথিবীর সেই রুদ্র মূর্তিটা আমরা দেখেছি, যখন আমাদের মায়েরা, বোনেরা ধর্ষিত হচ্ছিল, কন্যারা ধর্ষিত হচ্ছিল তখন পুজিবাদী দেশগুলো নির্বিকার। আমরা দেখেছি হাসতে হাসতে একটা বাচ্চা ছেলেকে পাথরের ওপর আছড়ে মারা হচ্ছে। কি করে একটা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমি আনসাকসেসফুল স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের কথা বলবো, সেখানে ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনী ব্যাপক গণহত্যা করলো, সে সময়ে স্পানিশ লিটারেচারে, ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে একটা তীব্র আলোড়ন এলো, যেমন নেরুদার একটি কাব্যগ্রন্থ বেরুলো মার্চেন্ট সোলজারদের জন্য কাগজের কারখানায় জুতা কাপড় যা ফেললো তা দিয়ে মণ্ড তৈরি হলো, কাগজে ছাপা হলো। মিগুয়েলের কথা বলতে পারি, সিভিল ওয়ারে সরাসরি অংশগ্রহণ করা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কথা বলতে পারি, কল্ডওয়েলের কথা বলতে পারি। একটা নতুন জেনারেশন কিন্তু রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতা বহু বছর পর আবার নতুন করে চর্চিত হলো নতুন পথ খুজে পেল। কিন্তু আমাদেরটা সাকসেসফুল যুদ্ধ, প্রচুর রক্তক্ষয় এবং প্রচুর মূল্য দিয়ে আমরা স্বাধীন ভূমি অর্জন করেছি। আমাদের ভেতরে বোধটা একটু আলাদা। আমার তো মনে হয় না যে, আমাদের এ কাজ দেখে তোমাদের মনে করা উচিত যে তোমাদের দায়িত্ব নেই। ভেবে দেখা দরকার যে, আত্মতৃপ্তির অবকাশ আছে কিনা। কবিতার ক্ষেত্রেও তো ভয়ানক একটা নৈরাজ্য চলছে আমি কলকাতার কথা বলবো না, কেননা সেখানে উত্থান-পতন পরিবর্তনের সম্ভাবনা আরো কম। আমাদের এখানে প্রতি মুহূর্তেই আমাদের রাজনৈতিক মেঘ যেমন রঙ বদলাচ্ছে, আমাদের সমুদ্র যে রকম নতুন করে ফুসে উঠছে আমাদের ভেবে দেখা দরকার যে, কোন পর্যায়ে লিটারেচারকে নতুন করে রিনোভেট করতে হয়। নতুন করে নির্মিতি কিভাবে হবে এবং তোমাদের কাজ হবে রিলে রেসের মতো। আমরা এতোদূর এগুলোম তোমরা এতোদূর। তোমাদের কবিতার দিকে তাকালে আমি হতোদ্যম হয়ে পড়ি- প্রথমত বোধ এবং বিষয়ের একটা আইকোনোকাস্টিক অবস্থা দেখতে পাই। এখনকার কবিতা পড়ে আমি ঠিক কনভিন্সড হই না। জীবনানন্দ, বিষ্ণুদের কবিতা পড়ে যে প্রচণ্ড মোহ এবং আবর্তের তৈরি হয় এখনকার কবিতা পড়ে ক্বচিৎ আমার সেটা হয়। মনে হচ্ছে যেন ওদের ভেতরে বলার একটা প্রচণ্ড তাগিদ আছে। কিন্তু ভেতরে সেই পরিমাণ আর্জ নাই, কবিতাকে একটা শিল্পরূপ দেয়ার যে শ্রম সেই জায়গাটায় তারা খাটতে রাজি নয়। অবশ্য সেটা নির্বিশেষ মন্তব্য নয়। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনাময় কবি-লেখক আছেন বিশেষ করে ছোট কাগজগুলোতে, অফ দি ওয়ে ম্যাগাজিনগুলোতে, এ পত্রিকাগুলোকে কেন্দ্র করে অনেক কবি-গদ্যকার উঠে আসার চেষ্টা করছেন। আমি এ কথা মনে করি না যে, একজন তরুণ কবি বা তোমাদের জেনারেশন খারাপ লিখলেই আমাদের সম্ভাবনা বেড়ে যায় বড় হওয়ার এ রকম কোনো নেগেশন কিন্তু শিল্পে নেই। বরং তোমরা ইয়াংরা যতো প্রচণ্ড বড় হবে আমাদের মূল্যায়নের ক্ষেত্র ততোটা স্পষ্ট হবে, আমাদের সঠিক মূল্যায়ন ইতিহাসে হবে। অন্ধকার যতো ঘনাবে ততোই অতীত আরো বেশি অন্ধকার হয়ে যাবে। আমরা এখন চলমান কিন্তু আমাদের জীবনের অধিকাংশ কাজ এখন অতীতের মধ্যে। বর্তমানে যেটুকু আছে সেটুকু আয়ুর জোরে; কলমের জোরে, কিন্তু তোমাদের ঘুরে দাড়াতে হবে একটা জায়গায়। সেটা হলো সৎভাবে খাটনি যেটা সেই খাটনিটা করতে হবে। আমি নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি, ‘কেরামত মঙ্গলের’র রাফ কপি দাড়িয়ে ছিল মোট পৌনে তিন হাজার পৃষ্ঠায়। অথচ নাটকটি ছিল দেড়শ পৃষ্ঠার। শকুন্তলা আমি লিখেছি আঠারবার। সব লেখকেরই তিন-চারটা যুগ থাকে লেখার প্রত্নপ্রস্তর যুগ, প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ তারপরে লৌহ যুগের লেখকের কবির ভাষাটা দাড়ায়। ইস্পাতের যুগে যে ঢুকতে পারবে সে অমর। মনে হয় আমি শকুন্তলায় ব্রোঞ্জ যুগে নিশ্চয়ই ছিলাম।’
‘কবিতার কথা যখন তুললেন এখানে আমি আপনার একটা কথা খুব ফিল করি সেটা হলো- অ্যাজ অ্যান আর্ট মিডিয়া কবিতা একটা ক্ষয়ীমান বিষয়। আমরা কবিতা লিখছি সেটা শুধুমাত্র আমি মাহবুব মোর্শেদ কবিতা লিখছি বিষয়টা এ রকম নয়। বিশ্ব কবিতার কিংবা বাংলা কবিতার ইতিহাসের মধ্যে বসে আমাকে লিখতে হচ্ছে। টোটাল বিষয়টা যখন আমি মাথায় রেখে লিখি- যে কোন আর্ট মিডিয়াতে কাজ করতে গিয়ে আমি তো চাই স্বকীয়তাকে তুলে আনতে। আমি আমার কথাটা কেন বলছি তার চেয়েও বড় কথা হলো আমি কিভাবে বলতে পারছি। কবিতার ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা আমার ধারণা আমাদের সবারই আছে। আমরা দেখছি, নাটকে আপনি যেসব নতুন নতুন কাজগুলো করছেন এখানে ফর্ম হয়তো খুব চেঞ্জ হচ্ছে না, দুই-তিনটা ফর্মে এটা আবর্তিত হচ্ছে। এটাও বড় একটা পাওয়া। কিন্তু আপনার সাফল্যের পেছনে আরো একটা কারণ আছে। সেটা হলো ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তন। হয়তো দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশের টাঙ্গাইল অঞ্চলের একটা প্রেক্ষাপট আবার মানিকগঞ্জে আরেকটা প্রেক্ষাপট অথবা নোয়াখালীর একটা ঘটনা লিখছেন। পাশাপাশি এই যে আপনার মানুষের ভূমিরেখা ধরে আবর্তন এটা কিন্তু আপনার কাজকে বেশি নতুনত্ব দিয়েছে। কবিতার ক্ষেত্রে আমি সমস্যাটা বললাম যে সমস্যাটা আমি ফিল করি, আমাদের মুক্তিটা সম্ভবত কবিতায় আর নেই- আমি এটা ফিল করছি। সেটা হয়তো গদ্য অথবা অন্য কোনো আঙ্গিকে।
‘আসলে বিশ্বব্যাপী কবিতার ক্ষয় বা ধস নেমেছে। এটার কারণ কিন্তু পাশ্চাত্যের পুজিবাদী সভ্যতা। সে মানুষকে মানুষের জায়গায় আর তিষ্টোতে দিচ্ছে না। খুব হাস্যকর বিষয় এটাকে আমরা কমপিউটারের যুগ বলছি। তার মানে এখন মানুষ নেই। কমপিউটার ব্যবসায়ীদের বানানো কথায় যারা পা দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই খুব বোকামি করেছে। মানুষকে অবমূল্যায়ন করেছে। মানুষকে কেটে ছেটে কমপিউটারের মাপ দিয়ে দিয়েছে। পৃথিবী সব সময় মানুষের। কবিতার ক্ষেত্রে ইওরোপিয়ান চিত্তের বিকাশটা যখন এমন স্থানে পৌছালো, একটা লোক ফ্রম ডন টু ডাস্ক মানি আর্নিং-এর কাজে ব্যস্ত। জীবনের কতো ডাইভারসিফাইড পণ্যের সঙ্গে তার উৎপাদন সংশ্লিষ্টতা রয়ে গেছে। গ্যেটের আমলে সেটা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের আমলে এটা ছিল না। এই জায়গাগুলো নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে পণ্য সভ্যতা। দিচ্ছে বলে বিত্তের ভারে চিত্তের অভাব ঘটছে। বিত্ত মানে পণ্য সভ্যতা। ধরো একটা ঘড়ি কিনতে বেরুলে- ইউ হ্যাভ এভরি রাইট টু সি দি ইচ অ্যান্ড এভরি ওয়াচ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। ঘড়ি দেখতে দেখতেই একটা জীবন তুমি কাটিয়ে দিতে পারো। একটা কাঠ পেন্সিলের এতো ভেরিয়েশশন পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে। পণ্য সভ্যতা তিলে তিলে মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে মানবীয় মূল্যবোধগুলোকে ছেটে সেখানে প্রোডাকশনের চিন্তাটাকে ভরে দেয়া হচ্ছে। আমার যে মেয়েটি যে কন্যাটি শত শত বছর আগে মসলিন বুনতো, একটা জাদুকরি মসলিন- কাপড়, বস্ত্র- সে এখন বিদেশিদের জন্য গার্মেন্ট সেলাই করছে। সেই হাত। মসলিন বুনতে বুনতে যেটুকু রূপকথা শুনতো তার সঙ্গে মসলিন বুনতে বুনতে সম্পর্কটা আরো নিকটতর হতো। এখন সেটি আর নেই। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে, প্রোডাকশন সংখ্যার সঙ্গে জড়িয়ে সে কিন্তু আর ভাবে না সেভাবে। কাজেই কবিতার স্থান সংক্ষিপ্ত হওয়ার জন্য পৃথিবী দায়ী কবিতার কোনো দোষ নেই। এটাও ঠিক যে, পৃথিবীর সর্ব শিল্পেরই ক্ষয় আছে। কবিতারও ক্ষয় এসেছে। প্রথমত, ইওরোপে কবিতার যে আধুনিকতা-সে ইওরোপ এমন এক জায়গায় পৌছে গেছে সেখানে কবিতার কথা, চিত্তের কথা, মানুষের নানা ঐশ্বর্যের কথা ভাবা এটির প্রয়োজন সেখানে আর নেই। ফুরিয়ে আসছে। মানুষের তো অবসর লাগে অবসরটা কোথায় মানুষের? এটা উপন্যাসের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে না। নাটকের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে না। অ্যামেরিকানরা এখনো ৫ থেকে ৬ পারসেন্ট নাটক দেখে, অতো কোটি লোকের মধ্যে। জার্মানি, ইংল্যান্ডে আরো বেশি। আমার কথা হলো, কালের ক্ষয়ে কবিতা লোপ পাবে, নাটকও লোপ পাবে। নাটকও লোপ পেতে বসেছে। যে জন্য আঙ্গিককে আমি ঃৎধহংভড়ৎস করতে চাচ্ছি। বিশ্বব্যাপী ডিরেক্টরের প্রবল দৌরাত্ম্যে নাটক এখন ডিরেক্টরের খেলার বিষয় হয়ে গেছে। ডিরেক্টর নিজেই শিল্পীর জায়গা দখল করে নিচ্ছে। সে জন্য আমাকে স্ক্রিপ্ট এর জায়গায় এতোটা স্ট্রং হতে হচ্ছে। উপন্যাসেও, ইওরোপে কি উপন্যাস লেখা হচ্ছে, ভালো? বিশাল, সাংঘাতিক মহৎ কিছু। ল্যাটিন আমেরিকায় সেটা হচ্ছে।
‘কুন্ডেরা লিখছেন, উমবের্তো একো লিখছেন।’ বললেন রাইন।
‘লিখছেন। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার মতো এতো বিশাল এতো ব্যাপ্তি সেখানে নেই। আফ্রিকান উপন্যাসেও এই বিশালত্ব আমরা দেখি। কবিতার আধুনিকতার জন্ম যেখানে সেখানটা রুদ্ধ হয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, কালের ক্ষয় লেগেছে। আমি মনে করি যে, কবিতার মৃত্যু নেই। সে অন্য কর্মে টিকে থাকবে। এখন যদি কেউ কবিতার আকারে একটা বৃহৎ উপন্যাস লেখে, তাতে উপন্যাসের কোনো ক্ষতি হবে না। কবিতার লাভ হবে।’
‘প্রিন্টিং মিডিয়ার অস্তিত্বই তো সামনে আর থাকছে না। ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগতে প্রবেশ করছি আমরা।’ বললেন রাইন।
‘যখন টেলিভিশন বেরুলো তখন সকলে ভাবলো চলচ্চিত্র আর থাকছে না। এখন দেখা যাচ্ছে চলচ্চিত্রই শিল্প মাধ্যম। ৫০/৬০ বছরে টেলিভিশন সেখানে পৌছাতে পারেনি। কাজেই কমপিউটার যতো দৌরাত্ম্য করুক, মানুষই সেই শক্তি যে এটার বিরুদ্ধে দাড়াবে। মানুষ যখন দেখবে সে নিজেকে হত্যা করছে। শিল্পের স্থান যতো সঙ্কীর্ণ হবে এ পৃথিবীতে মানুষের স্থানও ততো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’
সেলিম আলম দীন বললেন, পণ্য সভ্যতার বিরুদ্ধে দাড়াতে হবে ব্যক্তিকেই নিজের নিজের জায়গা থেকে। এই স্পন্দন প্রথমে ব্যক্তির মধ্যে জাগবে পরে ব্যক্তি এটা সমষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে দেবে। ইনডিভিজুয়ালের প্রতিবাদটা ইউনিফায়েড প্রতিবাদে পরিণত হবে। তিনি বললেন, এই প্রতিবাদের ধরনটা কেমন হবে সেটা কারো পক্ষে নির্ধারণ করে দেয়া উচিত নয়। পণ্য সভ্যতার পাশাপাশি যে শিশ্ন সভ্যতার বিকাশ এ সম্বন্ধেও বললেন তিনি। শেষ পর্যন্ত মানুষই এর বিরুদ্ধে দাড়াবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করলেন।
মৃত্যু
সাক্ষাৎকারে লেখকের মৃত্যুবোধ প্রসঙ্গে কথা ওঠে। সে প্রসঙ্গেই আমি বললাম, ‘আমরা কামনা করি আপনি একশ’ বছর বাচুন। কিন্তু জীবন প্রতি মুহূর্তেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষয় অর্থাৎ মৃত্যু বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
‘মৃত্যু বিষয়টা নিয়ে আগে খুব ভাবতাম এখন আর ভাবি না। বিশেষ করে ‘হরগজ’ লেখার পর আমার মনে হয় এ বিষয়ে আমার বলা হয়ে গেছে। ‘হরগজ’ অনেকটা আত্মজৈবনিকও বটে। ওর ভেতরে আমার নিজস্ব মৃত্যুভাবনাও আছে। মৃত্যু বিষয়টা আমাদের তাড়িত করে বলেই আমরা লিখছি, কাজ করছি। অনুপ্রাণিত হচ্ছি। তুমি যখন আমাকে দেখছ, সেলিম আল দীন বিশ বছর বাচবেন ম্যাক্সিমাম। তারপর তো তার সঙ্গে এই আড্ডাটা আর হচ্ছে না। আমি যদি অনন্তকাল বেচে থাকতাম তবে তোমরা আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসতে না। আমাদের সমস্ত কাজকেই নির্ধারণ করে দিয়েছে মৃত্যু। অমরত্বের আকাক্সক্ষা তীব্র হয়ে মৃত্যুভয় লেখককে লেখক করে। এই দুটো থেকে লেখক তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন শেষের দিকে বলেন- শিশুকাল থেকে প্রত্যেক মুহূর্তে আমি মৃত্যুভয়ে থেকেছি।
‘যারা আত্মহত্যা করে তারা মৃত্যুকে এক হাত দেখে নেয়ার চেষ্টা করে?’ বললেন রাইন।
‘হ্যা, তারা মৃত্যুকে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ করে। এটা এক ধরনের বোকামিও বটে। এ জন্য যে, তুমি না মরলেও তুমি এমনি মরবে। তুমি ভাবো যে, রবীন্দ্রনাথ আত্মহত্যা করেছেন, মৃত্যুভয়ে। তাহলে আমাদের মৃত্যুটা কতো কঠিন হয়ে যায়। আমরা দেখছি মৃত্যুর মুহূর্তে এক অসীম ধৈর্যের মধ্য দিয়ে তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। গ্যেটের মৃত্যুও তাই। আমাদের প্রফেটের মৃত্যুও তাই।’
‘লালন সাই’র মৃত্যুও।’ যোগ করলেন সাইমন।
‘আমাদের এখানে বেচে থাকাই যেখানে সবচেয়ে কঠিন, সেখানে আত্মহত্যা করা অর্থহীন।’ রাইন বললেন।
‘হ্যা, রাইন চমৎকার বলেছো।’
‘লেখক জীবনের শুরুতে আপনিও আত্মহত্যা করতে গিয়েছেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘এটা সম্পূর্ণ সত্য। এটা আমি চেষ্টা করি ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে। পরে আমার কাছে মনে হলো, আমি আর কয়টা দিন বেচে লিখে দেখি না। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাও একই রকম অ্যাটেমপ্ট নিয়েছিলেন। হয় গান শিখবেন, নইলে আত্মহত্যা করবেন’। ‘আবার যখন টলস্টয়, গ্যেটে, রবীন্দ্রনাথের মানসিক প্রস্তুতি দেখি তাতে মনে হয় সম্মুখে শান্তির পারাবার। টলস্টয় তো বলেছেন, কে বললো যে মৃত্যু কষ্টের। মৃত্যু তো সুখেরও হতে পারে’।
‘তখন কি আপনার আত্মহত্যার বাসনা জেগেছিল এই কারণেই যে লিখতে পারছিলেন না?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘না আমার কাছে মনে হচ্ছিল যে আমি খুব বড় লেখক বোধহয় হতে পারবো না। বিশাল কিছু হতে পারবো না। আমি অষ্টম শ্রেণীতেই শান্তি নিকেতনে পালাতে চেয়েছিলাম। নবম-দশম শ্রেণীতে রবীন্দ্রনাথের মেজর লেখা আমি পড়ে ফেলেছি। গ্রামে বসে। ফলে জীবন সম্পর্কে, শিল্পকৃতি সম্পর্কে আমার যে কৈশোরক ধারণা- যৌবনের শুরুতে সেটা তুঙ্গে পৌছেছিল। আমি দেখলাম আমি এটার একেবারেই উপযুক্ত না। তখন থিয়েটার আমাকে বাচিয়েছে। নাটক আমাকে বাচিয়েছে। ধীরে ধীরে আমি দেখলাম নাটক আমার অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতো। অর্থাৎ আমি জীবন সম্পর্কে যা বলতে চাই সবই বলা যায় নাটকের মধ্য দিয়ে। আমার আঙ্গিকে বলা যায়।
‘সফলতা আপনাকে বাচিয়ে দিল?’ বললাম আবার।
‘সফলতা আসলে কি? সফলতা সম্পর্কে জীবনানন্দের একটা কথা আছে। সফলতা কি আসলে সফলতা? এটা হয়তো এই জন্য যে, আঙ্গিকের দিক থেকে আমি আমার দেশের মানুষকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়ে কিছুটা হয়তো সফল হয়েছি। সেটাকে আমি ভাবছি সফলতা। কিন্তু আমার লেখা সফল নাও তো হতে পারে। সময় কোনগুলো নেবে না নেবে। রুক্নবর্ণে তো সে কথাই বলা হলো যে, আমার অমরত্বের আকাঙ্ক্ষাটাকে আমি খুব ঘৃণার সঙ্গে দেখি। খুব উপহাস করেছি নিজেকে।’ বললেন সেলিম আল দীন।
No comments:
Post a Comment