Monday, March 27, 2006

সি পেই
মাহবুব মোর্শেদ

যার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিল সকলে সেই বাবু হঠাত্‍ জাপান থেকে ফিরে এলো৷ বাবু লক্ষ্মী ছেলে৷ তাকে ফিটফাট, নির্বিরোধী, নিপাট ভদ্র ছেলে হিসেবে জানত সবাই৷ এ ধরনের ছেলেরা সাধারণত কারও ক্ষতি করে না, গায়ে পড়ে কারও উপকারও করতেও যায় না৷ সামনে থাকলে সবাই বলে ছেলেটা বড় ভাল, কিন্তু পেছনে গেলে কেউ আর বলে না, আহা অমুক সাহেবের ছেলেটাকে দেখি না অনেক দিন, গেল কোথায়? বাবু জাপান গেলে তাই কারও তার কথা সহসা মনে হয়নি৷ কিন্তু রফিক সাহেব, তার স্ত্রী ফাতেমা এবং পরিবারের সকলের ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়তো তার কথা৷ বাবু নিয়মিত চিঠি লেখে না, নিয়ম করে মেইলটা পর্যন্ত করে না, এই নিয়ে সব সময়ই তারা চিন্তায় থাকতো৷ ইমেইলের কথা সব থেকে বেশি মনে পড়তো নিতুর৷ বাবুর সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য ইমেইলের মতো কঠিন কাজটা অনেক যত্নে শিখে নিয়েছিল সে৷ কিন্ত বাবু মেইল করে না দেখে সে ভাবতো এখন যদি ভুলে যেতে পারতো বিদ্যাটা৷ কখনও কখনও পরিবারের সকলের মনে হতো, ছেলেটা কি তবে ভুলেই গেল তাদের৷ নিতু মাঝে মাঝে দুষ্টামি করে মাকে ক্ষেপানোর জন্য বলতো- দেখো তোমার ছেলে জাপানে কোনও মেয়েকে হয়তো বিয়ে করে সংসারি হয়ে গেছে৷ ফাতেমার মনে তখন একটা সংশয় দানা পাকিয়ে উঠতো৷ তিনি মেয়ের সাথে যুক্তি করতেন৷ নিজেকে নয়তো মেয়েকে বোঝানোর জন্য বলতেন, জাপানে মেয়ে পাবে কই? কেন সেখানে বাঙালি আছে না? পাল্টা প্রশ্ন করে মায়ের সন্দেহ ঘনীভূত করে তুলতো নিতু৷ অবশ্য এইসব বলা-কওয়া বা যুক্তি-তর্কই সার৷ নিতু নিজেই বিশ্বাস করতো না তাদের না জানিয়ে তার ঠাণ্ডা আলাভোলা ভাইটি বিদেশে গিয়ে একটা বিয়ে করে ফেলতে পারে৷ কথাবার্তা যা হতো সব মা-মেয়ের মধ্যে৷ রফিক সাহেবের চালচলন ভারিক্কি৷ তিনি সাংসারিক আলাপ-আলোচনায় ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করেন না৷ ছোটবেলা থেকে বাবু ও নিতুর মধ্যে তাকে নিয়ে একটা অজানা ভীতি ও রহস্য৷ তাদেরকে কোনও কথা বলতে চাইলে তিনি ফাতেমাকে মিডিয়া হিসাবে ব্যবহার করেন৷ কদাচিত্‍ বাবুর বেখেয়াল নিয়ে প্রশ্ন তার মধ্যে জাগে না এমন নয়৷ কিন্তু এ নিয়ে নিজের মতো করে ভাবেন তিনি৷ উত্তরও খুঁজে বের করেন সেভাবেই৷ সংসার তার কাছে সিরিয়াস ব্যাপার৷ তিনি চান, কথাবার্তা বলে একে হালকা না করতে৷ নিতু ভাইয়ের ফেরার অপেক্ষায় থাকতো সারাক্ষণ৷ ভাবতো, জাপান থেকে ভাই তার জন্য বড় মানুষের সমান কয়েকটা পুতুল আনবে৷ বড় একেটা কাগজের বাক্স খুলে বলবে, দেখ কী আনলাম তোর জন্য৷ জাপানিরা পুতুল খুব ভালোবাসে, বুুঝলি৷ এই কারণে তাদের সবার চেহারা পুতুলের মতো৷ ফাতেমার সাধ ছেলে কিছু জাপানি রান্না শিখে এসে তাকে রাঁধতে শেখাক৷ রান্নাবান্না তার কাছে প্রায় নেশার মতো৷ একেকটা তরকারি রান্না করতে করতে তিনি ভাবেন, কে জানে জাপানে এইটা কেমনে রাঁধে? ছেলেটাই বা কী খাচ্ছে? পরিবারের তিন সদস্যের ভাবনা, জল্পনা-কল্পনার ছেদ ঘটিয়ে নো মেইল নো চিঠি নো ফোন, একেবারে বিনা নোটিশে এক সন্ধ্যাবেলা বাবু হাজির৷ আর এই হাজির হওয়াটা স্রেফ হাজির হওয়াই নয়, রীতিমতো এক ঘটনা৷ বাড়ির সকলকে তো বটেই, পাড়া-প্রতিবেশীকেও অবাক করে দিল৷ তার ফেরা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলো কয়েক মাস৷ সন্ধ্যায় সে এসে পেঁৗছালো আর রাত নটা নাগাদ বাড়ি লোকে লোকারণ্য৷ সবাই দেখলো বাবু, তার মা এবং নীতু একটা জাপানি মেয়েকে ঘিরে বসে আছে৷ রফিক সাহেবকে দেখা যাাচ্ছে না৷ সম্ভবত তিনি ঘরের মধ্যে গুম হয়ে আছেন৷ এত গুরুতর ঘটনাতেও তার প্রতিক্রিয়া নিশ্চুপ থাকার৷ অথবা উত্তেজিত হলেও যথাসম্ভব ব্যক্তিত্ব দিয়ে চাপা রাখছেন৷ প্রতিবেশীরা নিতুকে ডেকে নিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করছিল, জাপানি মেয়েটা কে? বাবু কেন তাকে বাড়ি নিয়ে এলো ইত্যাদি ইত্যাদি৷ নিতু ধৈর্যের সাথে তাদের বোঝাচ্ছিল, তার ভাই জাপান গেলে হঠাত্‍ একদিন এক মেলায় সি পেই অর্থাত্‍ এই মেয়েটার সাথে আলাপ-পরিচয় হয়৷ প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে গেল, তারপর প্রেম-ভালাবাসা৷ তারপর আর কী? এবার ফেরার পথে একেবারে বিয়ে করে নিজের সঙ্গে নিয়ে ফিরল৷ এসব শুনতে শুনতে প্রতিবেশীরা বুঝতে পারে, সি পেইও বুঝতে পারছে তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে৷ সি পেই তাদের উদ্দেশে হাসে, মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান দেখায়৷ সকলে তার এই কাণ্ড দেখে হেসে তালি দিয়ে রীতিমতো একটা মজমা তৈরি করে ফেলে৷ কেউ বলে, এতো দেখি একেবারে পুতুলের মতো৷ গাটা যেন ননীর তৈরি৷ কেউ বলে, নিতু তোমার ভাবীকে আমরা ছুঁয়ে দেখবো৷ নিতু ভাবে কী ঝামেলায় না পড়া গেল৷ এ কি জাপানি পুতুল? পুতুলের মতো দেখতে বটে কিন্তু এরে তো প্রাণ আছে৷ সবাই একবার করে ছুঁয়ে দেখলে এ তো পুরোটা ক্ষয়ে যাবে৷ সে দূর থেকে ভাবীকে আগলে রাখার ভান করে বলে- না না৷ মনে মনে অনেক দায়িত্ব বোধ করে৷ সি পেইকে রক্ষণাবেক্ষণের মূল দায়িত্ব যে তারই সেটা সে বুুঝে নেয়৷ মধ্যরাতে পাড়া-প্রতিবেশীর ভীড় কমে গেলে নিতু সি পেইকে পাহারা দেয় আর ফাতেমা বউ-ছেলের জন্য ঘর গোছাতে থাকেন৷ একেবারে ফিটফাট করে ঘর গুছিয়ে এত্তটুকু সি পেইকে প্রায় কোলে করে ঘরে নিয়ে যান৷ সি পেইকে ছুঁয়ে তিনি একেবারে মোহিত৷ তার মনে হয়, এ মেয়ে মাখনের তৈরি না হয়েই যায় না৷ না জানি তার ছোঁয়ায় সি পেইর গায়ে কোনও আঘাত লাগলো কিনা৷ সি পেই জাপানি হলেও ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলে, সামান্য বোঝেও৷ কিন্তু যতটা বোঝে তার চেয়ে বেশি সে অনুভব করে৷ অনুভূতি যা বলে তাতে খুশি হয়ে ওঠে আপন মনে৷ নিতু আর ফাতেমার আপ্যায়নে বোঝে তাকে তারা খুব আপন করে নিয়েছে৷ অনুভবের ভাষা দিয়ে সে কথা বলে ওঠে৷ ফাতেমা তার কাছে গেলে, তাকে নির্বাক বাচ্চা মেয়ের মতো অাঁকড়ে ধরে৷ এই স্পর্শে ফাতেমা কেঁদে ফেলেন৷ বাবু একটা বিশ্বসুন্দরীকে বিয়ে করলেও তিনি খুশি হতেন না, যতোটা খুশি সি পেইকে বিয়ে করে আনায়৷ মনে মনে তিনি জাপানি জাতটার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন- তারা এত সুন্দর পুতুলের মতো মেয়ে তৈরি করেছে বলে৷ আর বিরক্ত হন, বাবুর বাবার ওপর৷ যতটা খুশি হওয়া দরকার, ততোটা খুশি কেন হচ্ছেন না কেন তা ভেবে৷ বাবু সি পেইর সাথে মাঝে মাঝে ফিসফাস করে কথা বলে৷ তাকে এটাসেটা বুঝিয়ে দেয়৷ সি পেই হাসে৷ কথায় কথায় মাথা নোয়ায়৷ বিরামহীনভাবে সকলকে ধন্যবাদ দিতে থাকে৷ নতুন দেশটিতে সে যে খুব সুখী হবে বুঝতে পারে৷ চারদিকে ছোট ছোট জ্বলজ্বলে পুতুলের চোখ নিয়ে তাকায়৷ সবকিছু চিনে নিতে চায়৷ সব ভাল লাগে তার৷ নিতুকে ভালোবাসা জানায়৷ পরিবারের আর সকলের মতো রফিক সাহেবকে একটু দূরের মানুুষ হিসেবে অবাক হয়ে দেখে৷ বুঝতে চেষ্টা করে, তার আসাটাকে কীভাবে নিয়েছেন রফিক সাহেব৷ পরদিন থেকে সবার মুখে মুখে শুধু সি পেই৷ সি পেই কেমন করে হাসে, মাথা নোয়ায়, তার নাকটা কেমন বোঁচা, চোখ কেমন ছোট তারপরও কেমন সুুন্দর, বাড়িতে থাকলে কী পরে, কাঠি দিয়ে কেন ভাত খায়, ওদের প্রেম কভিাবে হলো, কীভাবে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে জাপান থেকে ভেগে এলো এইসব হয়ে ওঠে সবার আলোচনার বিষয়৷ মাথা নিচু করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় পাড়ার মেয়েরা অবাক হয়ে বাবুর দিকে তাকায়, তাদের মনে হতে থাকে কেন যে আগে তার প্রেমে পড়লো না৷ বাবু জাপানি কেতা অনুসারে ফুলবাবু হয়ে ঘোরে৷ সবাইকে সালাম দেয় আর কেউ তাকে ভাল-মন্দ জিজ্ঞেস করলে মাথা নুইয়ে সম্মান দেখায়৷ পাড়া জুড়ে সবাই ধারণা করে জাপানি জাতটা হলো অমায়িক৷ মানুষকে সম্মান দেখাবার ক্ষেত্রে রীতিমতো ওস্তাদ৷ বিকাল হলে বাবু আর সি পেই ঘুরতে বের হয়৷ একটু দূর থেকে নিতু তাদের অনুসরণ করে৷ এরেকম হাঁটতে হাঁটতেই হঠাত্‍ সি পেই পিছন ফিরে নিতুকে জড়িয়ে ধরে৷ দেখে সবাই বলে, আহা পুতুলের মতো মেয়ে৷ সকলের সামনে এই আলিঙ্গনে নিতুর মনে হয়, জাপান দেশের সব থেকে দামী পুতুলটা আনলেও এতটা খুশি হতো না সে৷ ইতিমধ্যে সে তাকে ভাবী বলে ডাকতে শুরু করেছে৷ আর সি পেই বুুঝে নিয়েছে ভাবী হলো, ভাইয়ের বউ৷ অথবা আদর করে ভাইয়ের বউকে ভাবীই ডাকে এদেশের লোক৷ ফাতেমা রান্নার সময় সি পেইয়ের জন্য আলাদা পদ তৈরি করেন৷ জাপানিরা ঝাল একদম কম খায়, শাক-সব্জি প্রায় ভাপানোটা পছন্দ করে, সেই মতোই তিনি সি পেইয়ের জন্য রাঁধেন৷ সি পেই রাঁধতে চাইলে নিষেধ করেন৷ কারণ আগুনে তার সুন্দর গোলাপী ত্বকের ক্ষতি হতে পারে৷ দূরে উঁচু টুলের ওপর বসে সি পেই তাকে জাপানি রান্না শেখায়৷ তিনি রান্না পরখ করে যখন দেখেন ভাল হচ্ছে, স্বাদটা প্রায় বিদেশী খাবারের মতো, তখন রান্নার সাফল্যে সি পেইকে কোলে তুলে আদর করেন৷ মনে হয় সি পেই তার ছেলের বউ নয়, এ হলো রান্না শেখাবার জাপানি পুতুল৷ প্রতিবেশীরা বউ দেখার জন্য বারবার বাবুদের বাড়ি যেতে পারে না৷ বিকাল হলে তাকে দেখার জন্য বাড়ির বাইরে দাঁড়ায়৷ বাবু, নিতু আর সি পেইয়ের বের হওয়ার অপেক্ষা করে৷ বের হলে মরে হয় বিকালটা সার্থক৷ সবাই চায় সি পেইয়ের দৃষ্টি আকর্ষর্ণ করতে৷ সারাটা পথ সি পেই মাথা নোয়াতে নোয়াতে চলে৷ তাই দেখে ছেলে-বুড়ো সকলে হাসে৷ সবাই ভাবে তাদের বাড়ির সোমত্ত মেয়েটাকে জাপান ফেরতা বাবু বিয়ে করলেও তারা এতটা খুশি হতো না, যতটা খুশি তারা সি পেইয়ের আগমনে৷ জাপানি রান্নাগুলো আয়ত্ত করার পর ফাতেমা চান বাবুর বিয়ের অনুষ্ঠান হোক৷ জাপানি বউয়ের বউভাতের অনুষ্ঠানে তিনি সবাইকে জাপানি খাবার খাওয়াবেন৷ যেই ভাবা সেই কাজ৷ আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের দাওয়াত দিয়ে তিনি রাঁধতে বসেন৷ ছোট্ট সি পেই আর নিতু তাকে সাহায্য করে৷ প্রতিবেশী মেয়েদের সাহায্যে নিতু পুরো একতলা বাড়িটাকে রঙিন কাগজ আর ফুল দিয়ে সাজায়৷ পাড়ার ছেলেরা অনুষ্ঠানে সি পেই বসবে বলে একটা উঁচু মঞ্চ বানায়৷ বিকাল বেলা সবার আসার সময় হলে সি পেই জাপানি পোশাক পরে সেই মঞ্চের আসনে বসে৷ বাবু জাপান থেকে আনা সাউন্ড সিস্টেমে সি পেইয়ের প্রিয় একটা গান চালিয়ে দেয়৷ উপহারে উপহারে ভরে যায় মঞ্চ৷ উঁচু থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানায় সি পেই৷ ধন্যবাদ দেয়৷ বাবুর প্রতি তার প্রেম আরও বেড়ে যায়৷ জাপানে ফেলে আসা বাবা-মাকে ফিসফিস করে জানায়, দেখ বাবা-মা আমি কত সুখী৷ মনটা আনন্দে ভরে ওঠে৷ সি পেইয়ের দিনগুলো আর রাতগুলো ভালই কাটাচ্ছিল৷ সমস্যা নেই কিছুই, দেশটাকে নিজের ভাবতে মোটেও অসুবিধা নেই৷ মানুষগুলো সত্যিই তাকে আপন করে নিয়েছে৷ সামান্য সমস্যা আবহাওয়া৷ জাপান দেশটা ঠাণ্ডা৷ বাংলাদেশ হলো- গরম আর বৃষ্টির খনি৷ বৃষ্টি শুরু হলে কথাই নেই৷ জাপানেও বৃষ্টি প্রচুর হয়৷ তাই বৃষ্টিটা সয়ে গেলেও, গরম আর তার সয় না৷ একারণে যখন তখন ঘুমিয়ে পড়তো সে৷ বিশেষ করে বাড়ির ভেতরের বারান্দায় পাতা কাঠের চেয়ারে৷ ফাতেমার কাজ দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তো নিজেই জানতো না৷ অবশ্য বাড়ির লোকদের খারাপ লাগতো না ব্যাপারটা৷ সি পেই ঘুমাক আর জেগে থাকুক, তাকে সুন্দর দেখাতোই৷ ঘুম থেকে জাগলে তার শরীরের কাঠে লাগা অংশে দেখা যেত গভীর লাল দাগ৷ রফিক সাহেব একদিন সি পেইয়ের গালে এরকম লাল দাগ দেখে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন৷ কিন্তু কারও সাথেই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বললেন না৷ সন্ধ্যায় সোজা বাজারে গিয়ে ফোমের কুশন দেয়া একটা দোলনা কিনে আনলেন৷ নিজে দড়ি বেঁধে শক্ত করে বারান্দায় টাঙিয়ে সি পেইকে ডেকে তাতে বসালেন৷ বললেন, এখানে ঘুমাও মা৷ তার এই কাণ্ড দেখে তো ফাতেমা আর নিতু হেসেই খুন৷ কিন্তু সমস্যা হলো- তারা তো আর রফিক সাহেবের ব্যাপার নিয়ে প্রকাশ্যে হাসতে পারে না৷ তাদের চাপা হাসি অনেক সময় ধরে চলতে থাকলো৷ সি পেইয়ের হলো আরেক সমস্যা, বললেই তো আর ঘুমানো যায় না, তাই সে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ মনে মনে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো৷ পাড়ার সবাই কোনও না কোনও উপলক্ষে সি পেইয়ের প্রতি ভালোবাসা জানাবার পর রফিক সাহেবের ভালোবাসা প্রকাশিত হলো৷ তবুও সবাই খুশি, তাদের জানের জান সি পেই অবশেষে রফিক সাহেবের মতো রাশভারি লোকেরও মন পেল৷ কিন্তু এতো ভালোবাসা সি পেইয়ের সইলো না৷ অঘটন একটা ঘটলোই৷ সি পেইয়ের খুব সাইকেল চালাবার সখ ছিল৷ জাপানে তো সকলের সাইকেল আছে৷ কিন্তু আমাদের মফস্বল শহরেও সাইকেল চালানো খুব ঝক্কি৷ কিন্তু সি পেইয়ের এমনই শখ, কাউকে সাইকেল চালাতে দেখলে তার এক চক্কর চালানো চাই-ই চাই৷ এই দেখে রফিক সাহেব বাজার থেকে একটা সুন্দর সাইকেল কিনে আনলেন৷ সি পেই মহা খুশি৷ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, তবু সে সাইকেলে চক্কর মারছে তো মারছেই৷ শেষ পর্যন্ত ভূতের ভয় দেখিয়ে তাকে ক্ষান্ত করা হলো৷ সেদিনই রাত দশটার কাহিনী৷ ছেলে-পুলে দু'একজনের চলাফেরা ছাড়া রাস্তায় কেউ নেই৷ হঠাত্‍ দুএকটা রিকশার টুংটাং৷ ব্যস এইটুকুই শব্দ৷ রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো৷ এই নিরবতা খানখান করে হঠাত্‍ কয়েকটা গাড়ির শব্দ কানে এলো৷ রাস্তার ছেলেপুলেদের হুড়োহুড়িতে সজাগ হয়ে উঠলো সবাই৷ বাড়ি থেকে কেউ বের হলো না বটে কিন্তু নিঃশব্দ বেড়ালের মতো কান খাড়া করে রইলো৷ পুলিশ ঘিরে ফেলেছে পুরো পাড়া৷ কেউ ভেয়ে পাচ্ছে না, এ পাড়ায় কে এমন সন্ত্রাসী যে তাকে ধরতে পুরো পাড়াটাই ঘিরে ফেলতে হচ্ছে৷ হয়তো অন্য এলাকা থেকে আসা কোনো সন্ত্রাসী লুকিয়ে আছে, ভাবলো কেউ কেউ৷ কিন্তু পুলিশের একটা দল যখন বিদেশী কয়েকটা লোক ও একটা মহিলাসহ বাবুদের বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো তখন সবাই বুঝলো এ সন্ত্রাস-মন্ত্রাস নয়, রহস্য অন্যকিছু৷ একে একে সাহস করে একজন দু'জন এগিয়ে যেতে থাকলো বাবুদের বাড়ির দিকে৷ সে বাড়িতে ততক্ষণে কান্নার রোল৷ যেই গেল সেই কাঁদতে থাকলো বৃত্তান্ত শুনে৷ নিতু ফাতেমা তো বটেই, সি পেইও বাঙালিদের মতো শোর করে কাঁদছে৷ পুলিশসহ কয়েকটা জাপানি লোক আর জাপানি মহিলাটি ঘিরে আছে রফিক সাহেব আর বাবুকে৷ সি পেইয়ের বাবা-মা জাপান দূতাবাস আর বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করতে এসেছে৷ তাদের অভিযোগ, বাবু তাকে অপহরণ করে এদেশে নিয়ে এসেছে৷ রফিক সাহেব যতোই বোঝান ওরা ভালোবেসেই বিয়ে করেছে ততোই নাখোশ হয় পুলিশ৷ বলে, সরকার চায় না সি পেই এখানে থাকুক৷ জাপানি মেয়েটি জাপানে ফিরলেই শুধু সরকারের শান্তি৷ পুলিশ হুংকার ছাড়ে আর জাপানি লোকগুলো কিচির মিচির করতে থাকে৷ সি পেইয়ের বয়স আঠারো হয়নি৷ আঠারোর নিচের কোন মেয়েকে বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করা মানে অপহরণ৷ ফোঁপাতে ফোঁপাতে সি পেই প্রতিবাদ করতে থাকলো৷ বললো, সে যথেষ্ট বড়৷ বুঝেশুনেই তাকে বিয়ে করেছে৷ এখানে থাকতে চায় সে৷ কোথাও যেতে চায না৷ বাবা-মা তার দিকে এলেই খামচে তাদের দূরে সরিয়ে দিতে থাকলো৷ সময় যাচ্ছিল, একটু একটু করে ভীড়ও বাড়ছিল৷ লোকসংখ্যা বাড়ায় ভড়কে গেল পুলিশ আর জাপানিরা৷ পাড়ার লোকজন সাফ জানিয়ে দিল, সি পেই যেহেতু চায় না তাই কোনো শক্তিই তাকে পাড়ার বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না৷ অবস্থা খারাপ দেখে জাপানিরা ফিসফাস করে পুলিশের সাথে কথা বললো৷ তারপর পুলিশ, পাড়ার মুরুবি্ব এবং বাবুদের পরিবারকে নিয়ে মিটিং ডাকলো৷ মিটিং শুরুর আগে সিদ্ধান্ত যা হয় তা সবাইকে মেনে নিতে অনুরোধ করলো পুলিশ৷ শুরুতেই সি পেইয়ের বাবা-মা বাবুর সাথে তার বিয়ের ব্যাপারটা মেনে নিল৷ বললো, মেয়ে ভুল করলেও তার ভালোবাসা তো ভুল হতে পারে না৷ উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাাদ জানালো তারা তাদের মেয়ে এতটা আপন করে নিয়েছে বলে৷ রফিক সাহেব ও ফাতেমার প্রতি সম্মান দেখালো৷ বললো, সি পেইয়ের বয়স সামনের অক্টোবরে আঠারো হবে৷ তারা চায় নভেম্বরেই জাপানি রীতিতে আবার সি পেই ও বাবুর বিয়েটা সেরে ফেলতে৷ জাপানে তাদের বন্ধুরা নইলে খুবই নাখোশ হবে৷ তখন বাবুসহ পুরো পরিবারকেই জাপান গিয়ে সি পেইকে নিয়ে আসতে হবে৷ তবে তার আগের কয়েকটা মাস মেয়ে তাদের সঙ্গেই থাক৷ এই সময়টায় বাবা-মা তাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতে চান৷ বাকী জীবন তো এখানেই থাকবে৷ ব্যাপারটার সহজ সমাধান পেয়ে সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলো৷ বললো, আসলেই জাপানিরা ভদ্র জাতি৷ সি পেইও মেনে নিল৷ বাবুর মা-বাবা, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই অনুরোধ জানালো রাতটা তাদের সাথে কাটাতে৷ কিন্তু ভোরেই জাপানের ফ্লাইট বলে তারা সি পেইকে আদর করে গাড়িতে তুললেন৷ কেঁদে-কেটে সবার কাছে বিদায় নিয়ে জাপান চলে গেল সি পেই৷ ঘুম থেকে জেগে পাড়ার বাচ্চারও তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো৷ সি পেই বললো ফিরবে সে আবার এই নভেম্বরেই৷ পাড়ায় ফিরে সাইকেল চালিয়ে বেড়াবে৷ তখন সবার সঙ্গে আবার দেখা হবে৷ সি পেই বিহীন পাড়ায় পরদিন থেকে একটা অদ্ভূত নিরবতা নেমে এলো৷ সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যেতে থাকলো৷ দিন যেতে যেতে এক সময় পুুরো পাড়াটাই স্থবির নির্বাক হয়ে পড়লো৷ বাবু শুকাতে শুকাতে, চুপচাপ থাকতে থাকতে নিজের ভেতর সেঁধিয়ে গেল৷ অক্টোবর-নভেম্বর চলে গেলেও জাপান থেকে কোনো চিঠিপত্র বা দাওয়াত এলো না৷ পাড়ার বিষণ্ন ভাবটাই শেষ পর্যন্ত চিরস্থায়ী হয়ে গেল৷ প্রিয়, হাসিখুশি, পুতুল পতুল, নরম মাখন মাখন সি পেই আর কখনও ফিরে আসেনি৷

অক্টোবর, ২০০৫

No comments: