Monday, March 27, 2006

অর্ডার অব থিংস
মাহবুব মোর্শেদ


ঘরের বিন্যাস

বাসায় ঢোকার দরজা দুটি৷ প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকলে সোজা ড্রয়িংরুম৷ দ্বিতীয় দরজা দিয়ে একটা ডানে টার্ন, তারপর ডাইনিং স্পেস৷ ডাইনিং স্পেসের পর কিটেন ও দ্বিতীয় বেডরুম৷ দ্বিতীয় বেডরুমের পর প্রথম মানে মাস্টার বেডরুম৷ মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম৷ এটা বাসার বাম দিকের বিন্যাস৷ ডান দিক, অর্থাত্‍ ড্রয়িংরুম হয়ে বাসায় ঢুকলে ওই ছয়কোনা রুমের দুটি দরজার ডানেরটি দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই বাসার তৃতীয় বেডরুম- কখনো কেউ আতিথ্য গ্রহণ না করলেও এর নাম গেস্টরুম৷ গেস্টরুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং স্পেস হয়ে প্রথম বেডরুমে ঢোকা যেতে পারে৷ দিক দুটোকে আলাদা বিবেচনায নিলে দুটো আলাদা চিত্র তৈরি হয়৷ প্রথম পথ অর্থাত্‍ ড্রয়িংরুমের দরজা দিয়ে ঢুকলে বাসাটির কৌণিক বিন্যাসগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ ড্রয়িংরুমের ষড়ভূজ বিন্যাস দৃশ্যমানতার ভেতর আধিপত্য তৈরি করে৷ এখান থেকে তৃতীয় বেডরুমে মানে গেস্টরুমে ঢুকলে এর চৌকোনা বিন্যাসকে ষড়ভূজ বিন্যাসের চেয়ে দুর্বোধ্য মনে হয়৷ এবং এ ঘর থেকে ডাইনিং স্পেসে ঢুকলে কিচেন, দ্বিতীয় বাথরুম ও অন্যান্য রুমের বিন্যাসে তৈরি হওয়া- আঠারোটি কোন একসঙ্গে দৃশ্যমান হয়৷ আঠারো কোনের এই বিন্যাস থেকে প্রথম বেডরুম পর্যন্ত প্যাসেজটিকে একটি গোলাকার গুহার মতো দেখায়৷ ঘর অন্ধকার থাকলে পথটি অগম্য মনে হতে পারে৷ আলো যদি শুধু প্রথম বেডরুমে জ্বলে তবে পুরো গুহাটি হালকা আলোয় একটি ফানেলের আকার ধারণ করে৷ আলো ডাইনিং স্পেসে জ্বললে ফানেলটি উল্টো করে রাখা মনে হতে পারে৷ এই আয়তাকার টানেল যা ক্ষেত্রবিশেষে গোলাকারও মনে হতে পারে তা-ই কার্যত ঘরগুলোর বিন্যাসের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট নির্ধারণ করে দেয়৷ বাসায় আলোর বিন্যাস দ্বিতীয় দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমে বামে মেঝে থেকে তিন ফুট উঁচুতে তিনটি সুইচ৷ প্রথমটি ডাইনিং স্পেস সংলগ্ন বাথরুমের, দ্বিতীয়টি টানেলের প্রথমভাগের শুরুতে বেসিনের ওপর বসানো বাল্বের৷ তৃতীয়টি সিঁড়ি ঘরের৷ এখানে বাথরুম বা বেসিনের ওপরের আলো জ্বালিয়ে অনায়াসে দ্বিতীয় সুইচবোর্ডে যাওয়া চলে৷ এখান থেকে চারফুট দূরে বামের দেয়ালের আড়ালে পাঁচটি সুইচ৷ তৃতীয়টি ডাইনিং স্পেস আলোকিত করে৷ মূল টানেলের আলোর ব্যবস্থা টানেলের দ্বিতীয় অংশের শুরুতে, কিচেনের সুইচবোর্ডের উল্টো দেয়ালে৷ ডাইনিং স্পেসে আলো থাকলে প্যাসেজের আলোর প্রসঙ্গ নাও উঠতে পারে৷ অর্থাত্‍ টানেলে ছড়ানো আলোর রেখা ধরে সোজা প্রথম বেডরুমের সুইচবোর্ড পর্যন্ত পেঁৗছানো যায়৷ প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকলে সোজা পাঁচ ফুট হেঁটে ডানে টার্ন নিলে অর্ধচন্দ্রাকার ডিভানের বাম কোনায় পা ঠেকলে হাতের স্বাভাবিক উচ্চতায় পঞ্চম দেয়ালে সুইচবোর্ড৷ পাঁচটি সুইচের ডানেরটি ঘরের সাধারণ বাল্বের, চতুর্থটি ঝাড়বাতির, তৃতীয়টি ল্যাম্পসেডের, দ্বিতীয়টি ফ্যানের, প্রথমটি সকেটের৷ তৃতীয় বেডরুমের সুইচবোর্ড ঠিক উল্টোপিঠের দেয়ালে৷ অর্থাত্‍ এই অবস্থান থেকে দরজা ঠেলে দুইফুট পা বাড়ালে অগ্রবর্তী আরেকটি সুইচবোর্ড৷ যথারীতি সেখান থেকে প্যাসেজের মূল অংশের সুইচবোর্ড৷
আসবাবপত্র
প্রথম বিন্যাসে- ছোট তিনতলা জুতাদান৷ পাপোশ, চেয়ার, ডাইনিং টেবিল, ফ্রিজ, ওভেন ও টেবিল, দ্বিতীয় ফ্রিজ, সিঙ্ক, চুলা, বাসন-কোসনের র্যাক, বইয়ের আলমিরা, র্যাক, টেবিল, কম্পিউটার, বইয়ের তাক, স্টিলের আলমিরা, পাপোশ, ওয়্যারড্রোব, আলনা, টিভি, খাট, ড্রেসিং টেবিল, টুল, দোলনা চেয়ার.... দ্বিতীয় বিন্যাসে- পরপর তিনটি শখের হাড়ি, কার্পেট, সোফা, টব, ল্যম্পশেড, সোফা, টব, অর্ধচন্দ্রাকৃতি ডিভান, মিউজিক সিস্টেম, টেবিল, চেয়ার, খাট, ওয়্যারড্রোব.... এলোমেলো বিন্যাসে- কিচেনের ছোট ছাদ পুরো প্যাসেজে একটি ভীতিকর আবহ তৈরি করেছে সেখানে অগোছালো বিন্যাসে কুড়িটি ছোটবড় কার্টন, পুরাতন পেপারের দুটি গাদা৷ একটি ম্যাগাজিনের সতূপ৷
বসবাসরত প্রাণী
একটি ছোট ইঁদুর- কেবল গভীর রাতেই তার দেখা মেলে৷ ১৭টি তেলাপোকা, মশা হাজার তিনেক- নিধন সাপেক্ষে, চিনি জাতীয় কিছু থাকলে কালো পিঁপড়া তিনশ৷ মাছি ও টিকটিকি নেই৷ মানুষ একজন৷ আমার কথা বাসাটিতে আমি একা থাকি৷ একা থাকার জন্য একে প্রায় একটি সাম্রাজ্য মনে হতে পারে৷ আবার একটি বৃহত্‍ জঙ্গল মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয়৷ আমি রাতে বাসায় ফিরি৷ সকাল হলে বেরিয়ে যাই৷ ঠিক মনে করতে পারি না দিনের বেলা বাসাটিকে কেমন দেখায়৷ অফিসে বসে সরকারি বরাদ্দের বাড়িটির চেহারা আমি ঠিক মনে করতে পারি না৷ বন্ধুবান্ধবহীন অবিবাহিত জীবনে বাসাটি একসময় আমাকে অধিকার করে বসে৷ বাইরে থাকলে আমার শুধু ঘরে ফেরার কথা এবং ঘরে থাকলে বাইরে যাবার কথা মনে হয়৷ মাঝে মাঝে আমি সন্দেহ করি, এটা আসলে আমার পুলিশি চাকরির জীবনে কোনো বাসাই নয়৷ এটা বাইরে যাওয়া ও ঘরে ফেরার মাঝের একটা জটিল-বিন্যাসের সেতু৷ সাধারণত গভীর রাতে আমি বাসায় ফিরি৷ সিঁড়ি ঘরের হালকা আলো দেখে পথ চিনে পেঁৗছাই দুই দরজার সামনের একটা ফাঁকা স্থানে৷ দুই দরজাতেই তালা থাকে৷ দুটোর চাবিও থাকে আমার কাছে৷ ফলে, চাইলেই আমি বাম বা ডান দিক দিয়ে ঘরে ঢুকতে পারি৷ কিন্তু এই যে কোনো একটি দিক বেছে নেবার ওপর আমার পরবর্তী দিনটি কেমন যাবে তা নির্ভর করে৷ কেননা যে পথ দিয়ে আমি ঢুকবো আবশ্যিকভাবে সে পথ দিয়েই আমাকে বের হতে হবে৷ ফলে আমি সঠিক দরাজ দিয়ে প্রবেশ করছি কিনা এই ভাবনা খুব গুরুত্ববহ হলেও আমি কয়েক সেকেন্ডের একটা সুখবোধ করি৷ আমি এর নাম দিয়েছি নীতি-নির্ধারণী সুখ৷ এই ডিসিশন নিতে আমাকে অনেক কিছু সাটাসাট ভেবে নিতে হয়৷ ঘরের ভেতরটা আচানক আমার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়৷ ভুল ডিসিশন নিলে আর তার জন্য পরের দিন কোনো দুর্ভোগ তৈরি হলে আমি ঘরের প্রবেশের দরজা বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়ার ওপর দোষ চাপাই৷ আমি এতটুকুই অদৃষ্টবাদী৷ কিন্তু বাসায় আমি যেভাবে পথ চলি তাকে আমাকে দৃষ্টবাদী বলারও কোনো সুযোগ নেই৷ বাসাটিতে আমার বসবাসের মেয়াদ ও বাসার সঙ্গে আমার আত্মিক বন্ধনের মধ্য দিয়ে এতে ছড়ানো বস্তুগুলোর সঙ্গে আমার যে রিলেশন তৈরি হয়েছে তাতে আমি খানিকটা অন্ধের মতো পথ চলি৷ বাসার কোনো কিছু সহসা স্থান বদল করে না৷ ফলে, যে জায়গায় যে চেয়ার তা সে জায়গাতেই থাকে৷ সকালে যে বিছানা রেখে যাই, রাতে তা-ই ফিরে পাই৷ ফলে পুরো বাসায় ঘুরতে আমাকে যে চোখ খোলা রেখেই পা ফেলতে হয় তা ঠিক নয়৷ আমি আসলে এই অর্ডার অব থিংসের মধ্যে একধরনের অন্ধত্বের আনন্দ বোধ করি৷ পেশায় পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগে নিযুক্ত৷ তথাপি আমি পড়াশুনা করি৷ গভীর রাত অব্দি জাগি, অনিয়ম করি৷ স্ট্যাডি অর্থাত্‍ দ্বিতীয় বেডরুমে আমার অনেকটা সময় কাটে৷ বাসায় এই অবস্থানকে তুলনা করতে পারি- বোর্হেসের অন্ধত্বের সময়ের অভিজ্ঞতার সঙ্গে৷ সম্ভবত সেটা যুত্‍সইও৷ কিন্তু হঠাত্‍ এক রাতে আমি বিস্ময়ে- বিমুঢ় হয়ে পড়ি৷
একরাতের ঘটনা
মেটামরফসিস পড়ছিলাম৷ কখন কী ঘটেছে জানি না৷ কত সময় গিয়েছে তাও বলতে পারি না৷ হঠাত্‍ তন্দ্রা ভর করেছিল৷ হঠাত্‍ তন্দ্রা টুটলে আচানক জাগরণের ধাক্কায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ি৷ বিছানায় শুয়ে বই পড়লে এমন হয়৷ হতে পারে৷ কিন্তু বসে পড়লে এমন ঘটে না৷ শুয়ে হালকা গোছের চিন্তাহীন বই আমি পড়তে পারি, কিন্তু ভারি কোনো কিছু পড়তে গেলে দিনের সব ক্লান্তি এসে একবারে শরীরে ভর করে৷ চেয়ারে বসেই পড়ছিলাম বলেই মনে আছে৷ তন্দ্রা থেকে জেগে একটু অবাক হলাম৷ স্বাভাবিকভাবে আমার টেবিলে উপুড় হয়ে বসে থাকার কথা৷ চোখ খুলে সোজা বইয়ের তাক দেখা যাবার কথা৷ কিন্তু তা দেখতে না পেয়ে একটা অচেনা শঙ্কা জাগে৷ তবে কি টেবিলে চিত্‍ হয়ে শুয়ে আছি? চিত্‍ হয়ে শুলে চোখে পড়বে ফ্যানঅলা ছাদ৷ কিন্তু তাও দেখা যাচ্ছে না৷ তবে কি উল্টো হয়ে শুয়েছি? তবে চোখ খুললে সোজা মেঝে দেখা যাবার কথা৷ না আপাতত কোনো মেঝে জাতীয় ব্যাপার চোখে পড়ছে না৷ তবে কি আমি স্ট্যাডি নয় প্রথম বা তৃতীয় বেডরুমে শুয়ে আছি? অথবা যা কখনোই ঘটে না, অন্য কারও বাসায় ঘুমিয়েছি? না, অফিস শেষ করে সোজা বাসায় ফিরেছি৷ খেয়ে পড়তে বসার আগের আর কোনো ঘটনা আমার মনে পড়ে না৷ তবে কি দুঃস্বপ্নের ভেতর জাগনা পেয়ে ভয় পাচ্ছি শুধু শুধু? আর একটা ব্যাপার, আমার মনে হচ্ছে আমি চিত্‍ হয়ে আছি, কিন্তু চিত্‍ হয়ে শুয়ে থাকার মতো আরাম লাগছে না৷ বরং উপুড় হয়ে আছি মনে হচ্ছে, ঠিক তাও না- হাত-পায়ের অাঁকশির সাহায্যে স্রেফ দেয়াল অাঁকড়ে ধরে আছি৷ এবার নিশ্চিত যে আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন৷ সেখান থেকে স্বপ্ন দেখছি এবং স্বপ্নে উল্টাপাল্টা ভাবছি৷ ব্যস নিশ্চিন্ত৷ কিন্তু নিশ্চিন্ত বললেও নিশ্চিন্ত থাকা যাচ্ছে না, প্রথম ও প্রধান সমস্যা চেতনা৷ স্বপ্নের ভেতর এত সজাগ চেতনা কোনো দিনই আমি পাইনি৷ ফলে স্বপ্নটা হজম করতে একটু কষ্ট হচ্ছে৷ আড় চোখ চারদিকে তাকাই৷ উপরের দিকে অর্থাত্‍ নিচের দিকে তাকাতেই প্রাণ যাওয়ার অবস্থা হয় আমার৷ মহাশূন্যে ঝুলে আছি রীতিমতো৷ কোনো অবলম্বন ছাড়া, স্রেফ ঝুলে আছি৷ এ কেমন কথা? বৈজ্ঞানিকভাবে এটা সম্ভব নয়৷ তারপরও ঝুলে থাকা থেকে একটু সরে আসি৷ হঁ্যা, সরা যায়৷ দেহের ভর স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০০০ভাগ কমে এসেছে৷ পা দেয়াল আকৃষ্ট করে থাকতে পারছে৷ সবচেয়ে বড় কথা, আমি সামনে পিছনে তাকাতে পারছি, এমনকি নিজের দেহটাকেও দেখলাম একবার৷ আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল সেখানে, রীতিমতো টিকটিকির রূপ পেয়েছে দেহটা৷ মেটামরফসিস? নিমেষে আইডিয়াটা মাথায় ঝড় বইয়ে দেয়৷ কিন্তু স্রেফ একটা টিকটিকি? একটা টিকটিকি হলাম! নিজের এই পরিণতিতে তীব্র অট্টহাস্য জাগে৷ অট্টহাসির বদলে আমি এমন একটা শব্দ নিজের কানে শুনি যাকে অট্টহাসি নয় স্রেফ একটা ফুঁ বলা যায়৷ কোথাও আর মুখ দেখানোর জায়গা থাকলো না৷ কাউকে বলাও সম্ভব নয়, এক তন্দ্রার অবকাশে স্রেফ টিকটিকিতে পরিণত হয়েছি৷ বলা না-বলা পরের কথা, আপাতত ছাদ থেকে নামতে চাই আমি৷ মেঝেতে না নামলে, ঘরের অর্ডার অব থিংসটা আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে না৷ মোটকথা, টিকটিকি হিসাবে আমার কোনো স্মৃতি নেই৷ থাকলে তার বয়স স্রেফ কয়েক মিনিট৷ ফলে আপাতত মানুষের স্মৃতিনির্ভর হয়েই আমাকে চলতে হবে৷ টিকটিকির চিন্তায় মানুষের চিন্তা ঢোকাতে হবে৷ একটা সমন্বয় স্থাপন করতে হবে৷ যেমন নামতে গিয়ে পড়ে যাবার মানবিক ভয়টা আমি পাচ্ছি বটে কিন্তু ছাদে যে স্রেফ ঝুলে আছি তাতে এক ধরনের টিকটিকীয় নির্ভরতাও জাগছে৷ দেখতে পাচ্ছি অল্প৷ তাতেই সই, বুক ধক ধক করে চলতে শুরু করলাম৷ সম্ভবত ঘন্টা তিনেকের মধ্যে একটা টিউব লাইটের পাশ দিয়ে, রবীন্দ্রনাথের পোস্টার হয়ে, মার্চ মাসের ক্যালেন্ডার পেরিয়ে নেমে এলাম মেঝেতে৷ টিকটিকিদেরকে বেশ দ্রুতই চলতে দেখা যায়৷ আমার বেলায় আতেটা সময় লাগায় অনুভব করি, আমার পূর্ণ রূপান্তর ঘটে নাই৷ অথবা স্বল্পায়ু প্রাণীর আয়ু লাভের কারণে সময় বিষয়ে আমার ভাবান্তর ঘটে গেছে৷ মেঝে থেকে রিডিং টেবিলের ওপর উঠে আমি প্রথমেই গোলমালটার উত্‍স সন্ধান করি৷ কোন দুঃখে যে মেটামরফসিস বইটা পড়তে ধরেছিলাম৷ মেটামরফোসিসের ওপর উঠে কয়েকটা লাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে আসি৷ গ্রেগর সামসা নামটা সহসাই মনে পড়ে৷ নিজের মনে হেসে উঠি৷ চিন্তাশুদ্ধ পুরো টিকটিকি হয়ে গেলে হয়তো এসব ভাবা সম্ভব হবে না৷ যতোক্ষণ ভাবা যাচ্ছে ভাবি৷ ভেবেছিলাম, হয়তো বা কাক হবো৷ কীসের কি টিকটিকি হয়ে পড়ে আছি৷ বাইরের দুটো দরজাই বন্ধ৷ টিকটিকি অবস্থায় দরজা খোলার সাধ্য আমার নেই৷ অবশ্য তাতে আমার বের হওয়ার অসুবিধা নেই৷ দরজার নিচ দিয়ে দিব্যি বের হতে পারি৷ কিন্তু যাবো কোথায়, অফিসে? কী করবো অফিসে গিয়ে? আমিই যে সেই গোয়েন্দা কর্মকর্তা সেটা কেউ বিশ্বাস করবে? না কি আমি তা বলতে পারবো? তাছাড়া রাস্তায় কারো ঠ্যাংয়ের নিচে চ্যাপ্টা হয়ে গেলে কিছু বলার থাকবে না৷ সব ভেবে চিন্তে ঘর থেকে বেরুবো না বলেই মনস্থ করলাম৷ পেটার বেকসেলের বইটা টেবিলের এক পাশে বন্ধ অবস্থায় আছে, আমার সাধ্য নেই উল্টিয়ে পড়বো৷ খোলা আছে শুধু মেটামরফসিস৷ পড়া যায়, চাইলে দুএকটা পাতা কসরত্‍ করে উল্টিয়ে দিতে পারি৷ এমন একটি মহান গ্রন্থ পড়া শেষ না করেই টিকটিকি জীবন শুরু করবো? তলস্তয় পড়লাম না, দস্তয়েভস্কি পড়লাম না৷ রবীন্দ্রনাথেরও কত কিছু বাকী৷ এই অবস্থায় আচানক এই টিকটিকি৷ নিঃসঙ্গ, একা৷ ভ্যান্টিলিটার বেয়ে পাশের বাসার ব্যক্তিগত জীবনে হানা দিতে পারি৷ নিজের টেলিভিশন তো ছাড়তে পারবো না৷ ওদের টেলিভিশন আছে, চাইকি দু'একটা খবর শোনা, অনুষ্ঠান দেখা যেতে পারে৷ ঘরে বসে দুনিয়ার হালচাল বোঝার একটাই উপায়, ভাবি আমি- মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখা৷ প্রতিবেশীদের ওপর চোখ রাখা৷ তারা কই যায়, কী করে, কী বলে৷ টিকটিকি সম্পর্কে সময় থাকতে পড়াশুনা না করায় পস্তাই খানিক৷ নিজে টিকটিকি হয়েও কত কম জানি এখন৷ অথচ মানুষ সম্পর্কে কত জ্ঞান আমার৷ টিকটিকির লেজ নড়বড়ে, কিন্তু এটা মূল্যবান অঙ্গ- এটুকুই আমার জ্ঞান৷ লেজ নেড়ে অনুভব করি৷ মানুষ নুনুর মতোই মহাঘর্্য এক বস্তু মনে হয় একে৷ কিন্তু স্পর্শকাতর অঙ্গটি নিশ্চয়তার বদলে খানিকটা ভয়ই ধরায়৷ অঙ্গটি বাঁচাবার প্রাণপণ চেষ্টায় আমার কর্তব্য নির্ধারিত হয় কোনো অবস্থাতেই মানুষের হাতের নাগালে চলে না যাওয়া৷ এ অবস্থায় বাইরে কি এ ধরনের প্রচারণা চলতে পারে যে, আমাকে খুন করে গুম করে দেয়া হয়েছে?

No comments: